অনীশ ১ম অংশ
অনীশ ১ম অংশ
হাসপাতালের কেবিন ধরাধরি ছাড়া পাওয়া যায় না, এই প্রচলিত ধারণা সম্ভবত পুরোপুরি সত্যি নয়। মিসির আলি পেয়েছেন, ধরাধরি ছাড়াই পেয়েছেন। অবশ্যি জেনারেল ওয়ার্ডে থাকার সময় একজন ডাক্তারকে বিনীতভাবে বলেছিলেন, ভাই একটু দেখবেন – একটা কেবিন পেলে বড় ভাল হয়। এই সামান্য কথাতেই কাজ হবে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আজকালকথাতে কিছু হয় না। যে-ডাক্তারকে অনুরোধ করা হয়েছিল তিনি বুড়ো। মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হয় সমগ্র মানবজাতিরউপরই তিনি বিরক্ত। কোনো ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মানবজাতি নিঃশেষ হয়ে আবার যদি এককোষী ‘অ্যামিবা’ থেকে জীবনের শুরু করে তা হলে তিনি খানিকটা আরাম পান। তাঁকে দেখে মনে হয়নি তিনি মিসির আলির অনুরোধ মনে রাখবেন। কিন্তু ভদ্রলোক মনে রেখেছেন। কেবিন জোগাড় হয়েছে পাঁচতলায়। রুম নাম্বার চারশো নয়।
সব জায়গায় বাংলা প্রচলনহলেও হাসপাতালের সাইনবোর্ডগুলি এখনও বদলায়নি। ওয়ার্ড, কেবিন, পেডিয়াট্রিকস এসব ইংরেজিতেই লেখা। শুধু রোমান হরফের জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা হরফ। হয়তোএগুলির সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায়নি। কেবিনের বাংলা কি হবে? কুটির? জেনারেল ওয়ার্ডের বাংলা কি ‘সাধারণ কক্ষ’?
যতটা উৎসাহ নিয়ে মিসির আলি চারশো নম্বর কেবিনে এলেন ততটা উৎসাহ থাকল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করলেন – বাথরুমের ট্যাপ বন্ধ হয় না। যত কষেই প্যাঁচ আটকানো যাক ক্ষীণ জলধারা ঝরনার মতো পড়তেই থাকে। কমোডের ফ্ল্যাশও কাজ করে না। ফ্ল্যাশ টানলে ঘড়ঘড় শব্দ হয় এবং কমোডের পানিতে সামান্যআলোড়ন দেখা যায়। এই পর্যন্তই। তার চেয়েও ভয়াবহ আবিষ্কারতা করলেন রাতে ঘুমোতে যাবার সময়। দেখলেন বেদের পাশে শাদা দেয়ালে সবুজ রঙের মার্কার দিয়ে লেখা –
“এই ঘরে যে থাকবে
সে মারা যাবে।
ইহা সত্য। মিথ্যা নয়।।”
মিসির আলির চরিত্র এমন নয় যে এই লেখাদেখে তিনি আঁতকে উঠবেন এবং জেনারেল ওয়ার্ডে ফেরত যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তবে বড় রকমের অসুখ-বিসুখের সময় মানুষের মন দুর্বল থাকে। মিসির আলির মনে হল তিনি মারাই যাবেন। সবুজ রঙের এই ছেলেমানুষি লেখার কারণে নয়, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মে। তার ‘লিভার’ কাজ করছে না বললেই হয়। মনে হচ্ছে লিভারটির আর কাজ করার ইচ্ছাও নেই। শরীরের একটি অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে অন্য অঙ্গগুলিও তাকে অনুসরণ করে। একে বলে সিমপ্যাথেটিক রিঅ্যাকশন। কারও একটা চোখ নসত হলে অন্য চোখের দৃষ্টি কমতে থাকে। তাঁর নিজের বেলাতেও মনে হচ্ছে তা-ই হচ্ছে। লিভারের শোকে শরীরের অন্যসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গও কাতর। একসময়ফট করে কাজ বন্ধ করে দেবে। হৃদপিণ্ড বলবে – কী দরকার গ্যালন গ্যালন রক্ত পাম্প করে? অনেক তো করলাম। শুরু হবে অনির্দিষ্টের পথে যাত্রা। সেই যাত্রা কেমন হবেতিনি জানেন না। কেউই জানে না। প্রাণের জন্ম-রহস্য যেমন অজানা, প্রাণের বিনাশ-রহস্যও তেমনি অজানা।
তিনি শুয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। বেল টিপে নার্সকে ডাকলেই সে কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেবে। মিসির আলির ধারণা এরা ঘুমের ট্যাবলেট অ্যাপ্রনের পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রোগীর সামান্য কাতরানির শব্দ কানে যাবামাত্র ঘুমের ট্যাবলেট গিলিয়ে দেয়। কাজেই ওদের না ডেকে মাথার যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে থাকাই ভাল। শুয়ে শুয়েমৃত্যুর পরের জগৎ নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে।
ধরাযাক মৃত্যুর পরে একটি জগৎ আছে। পার্টিকেলের যদি অ্যান্টি-পার্টিকেল থাকতে পারে, ইউনিভার্সের যদি অ্যান্টি- ইউনিভার্স হয় তা হলে শরীরে অ্যান্টি-শরীর থাকতে সমস্যা কী? যদি মৃত্যুর পর কোনো জগৎ থাকে কী হবে সেইজগতের নিয়ম কানুন? এ-জগতের প্রাকৃতিক নিয়নকানুন কি সেই জগতেও সত্যি? এখানে আলোর গতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল, সেখানেও কি তা-ই? নিউটনের গতিসূত্র কি সেই জগতের জন্যেও সত্যি? হাইজেনবার্গের আনসারটিনিটি প্রিন্সিপ্যাল? একই সময়ে বস্তুর গতি এবং অবস্থান নির্ণয় করা অসম্ভব। পরকালেও কি তা-ই? নাকি সেখানে এটি খুবই সম্ভব?
মিসির আলি কলিংবেলের সুইচ টিপলেন। প্রচণ্ড বমি-ভাব হচ্ছে। বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছেন না, আবার একা একা বাথরুম পর্যন্ত যাবার সাহসও পাচ্ছেন না।মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে বাথরুমের দরজায় পড়ে যাবেন।
অল্পবয়েসি একজন নার্স ঢুকল। তাঁর গায়ের রঙ কালো, মুখে বসন্তের দাগ, তাঁর পরও চেহারায় কোথায় যেন একধরনের স্নিগ্ধতা লুকিয়ে আছে। মিসির আলি বললেন, ‘এত রাতে আপনাকে ডাকার জন্য আমি খুব লজ্জিত। আপনিকি আমাকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে যাবেন? আমি বমি করবো।’
‘বাথরুমে যেতে হবে না। বিছানায় বসে বসেই বমি করুন – আপনার খাটের নিচে গামলা আছে।’
সিস্টার মিসির আলিকে ধরে ধরে বসালেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, বমি-ভাব সঙ্গে সঙ্গে কমে গেল। মিসির আলি বললেন, ‘সিস্টার, আপনার নাম জানতে পারি?’
‘আমার নাম সুস্মিতা। আপনি কিএখন একটু ভাল বোধ করছেন?’
‘বমি গলা পর্যন্ত এসে থেমে আছে। এটাকে যদি ভাল বলেন তা হলে ভাল।’
‘আপনারকি মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?’
‘হচ্ছে।’
‘খুব বেশি?’
‘হ্যাঁ,খুব বেশি।’
‘আপনি শুয়ে থাকুন। আমি রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ানকে ডেকে নিয়ে আসছি। তিনি হয়তো আপনাকে ঘুমের ওষুধ দেবেন। তা ছাড়া আপনার গা বেশ গরম। মনে হচ্ছে টেম্পারেচার দুই-এর উপরে।’
সুস্মিতা জ্বর দেখল। আকশো দুই পয়েন্ট পাঁচ। সে ঘরের বাতি নিভিয়ে ডাক্তারকে খবর দিতে গেল।
মিসির আলি লক্ষ করছেন তাঁরমাথার যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে। ঘর অন্ধকার, তবু চোখ বন্ধ করলেই হলুদ আলো দেখ যায়। চোখের রেটিনা সম্ভবত কোনো কারণে উত্তেজিত। ব্যথার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক আছে কি? আচ্ছা – জ্বর মাপার যন্ত্র আছে থার্মোমিটার । ব্যাথা মাপার যন্ত্র এখনও বের হল না কেন? মানুষের ব্যাথাবোধের মূল কেন্দ্র মস্তিষ্ক। স্নায়ু ব্যাথার খবরমস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। যে-ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ব্যথার পরিমাপক সেই সিগন্যাল মাপা কি অসম্ভব?
ব্যথা মাপার একটা যন্ত্র থাকলে ভাল হত। প্রসববেদনার তীব্রতা নাকি সবচে’ বেশি । তার পরেই থার্ড ডিগ্রী বার্ন। তবে ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতাও একেক মানুষের একেক রকম। কেউ কেউ তীব্র ব্যথাও সহ্য করতে পারে। মিসির আলি পারেন না। তাঁর ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকতে। ব্যথা ভোলবার জন্যে কী করা জায়? মস্তিষ্ককে কি কোনো জটিল প্রক্রিয়ায় ফেলে দেয়া যায় না? উলটো করে নিজের সঙ্গে কথাবললে কেমন হয়? কিংবা একই বাচ্য চক্রাকারে বলা যায় না?
শিবে বখু কি থাব্য?
শিবে বখু কি থাব্য?
শিবে বখু কি থাব্য?
নার্স ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বাতি জ্বালাল। ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
মিসির আলি বললেন, ‘আমার ডেলিরিয়াম হচ্ছে। আঁকতই বাক্য বারবার উলটো করে বলছি। ‘ব্যাথা কি খুব বেশি’ – এই বাক্যটিকে আমি উলটো করে বলছি, থাব্য কি বখু শিবে?’
ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘কোনো রোগীর যখন ডেলিরিয়াম হয় সে বুঝতে পারে না যে ডেলিরিয়াম হচ্ছে।’
‘আমি বুঝতে পারি। কারণ আমার কাজই হচ্ছে মানুষের মনোজগৎ নিয়ে। ডাক্তার সাহেব, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিন। সম্ভব হলে খানিকটা অক্সিজেন দেবারও ব্যবস্থা করুন। আমার মস্তিষ্কে অক্সিজেন ডিপ্রাইভেশন হচ্ছে। আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।’
‘কী হ্যালুসিনেশন?’
‘আমি দেখছি আমার হাত দুটো অনেক লম্বা হয়ে গেছে। এখন লম্বা হচ্ছে।’
মিসির আলি গানের সুরে বলতে লাগলেন –
‘ম্বাল তক তহা রমাআ ।
ম্বাল তক তহা রমাআ ।
ম্বাল তক তহারমাআ ।’
ডাক্তার সাহেব নার্সকে প্যাথিড্রিন ইনজেকশন দিতে বললেন।
* মিসির আলির ঘুম ভাঙল সকাল নটার দিকে।
ট্রেতে করে হাসপাতালের নাশতা নিয়ে এসেছে। দু স্লাইস রুটি, একটা ডিমসেদ্ধ, একটা কলা এবং আধগ্লাস দুধ। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটির জন্যে বেশ ভাল খাবার স্বীকার করতেই হবে। তবু বেশির ভাগ রোগী এই খাবার খায় না। তাদের জন্যে টিফিন-ক্যারিয়ারে ঘরের খাবার আসে। ফ্লাস্কে আসে দুধ।
জেনারেল ওয়ার্ডের অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। সেখানকার রোগীরা হাসপাতালের খাবার খুব আগ্রহ করে খায়। যারা খেতে পারে না তারা জমা করে রাখে। বিকেলে তাদের আত্মীয়স্বজনরা আসে। মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে এই খাবারগুলি তারা খেয়ে ফেলে। সামান্য খাবার, অথচ কী আগ্রহ করেই-না খায়! বড় মায়া লাগে মিসির আলির। কতবার নিজের খাবার ওদের দিয়ে দিয়েছেন। ওরা কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়েছে।
আজকের নাশতা মিসির আলি মুখে নিতে পারলেন না। পাউরুটিতে কামড় দিতেই বমি-ভাব হল। এক চুমুক দুধ খেলেন। কলারখোসা ছাড়ালেন, কিন্তু মুখে দিতে পারলেন না। শরীর সত্যি সত্যি বিদ্রোহ করেছে।
খাবার নিয়ে যে এসেছে সেতাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। রোগী খাবার খেতে পারছে নাএই দৃশ্য নিশ্চয়ই তার কাছে নতুন নয়। তবু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দুঃখিত। লোকটি স্নেহময় গলায় বলল, ‘কষ্টকইরা খান। না খাইলে শরীরে বল পাইবেন না।’
মিসির আলি শুধুমাত্র লোকটিকে খুশি করার জন্য পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে মুখে দিলেন। খেতে কেমন যেন ঘাসের মতো লাগছে।
আজ শুক্রবার।
শুক্রবারে রুটিন ভিজিটে ডাক্তাররা আসেন না। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁদের ঘর-সংসার আছে, পুত্রকন্যা আছে। জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী আছে। একটাদিন কি তাঁরা ছুটি নেবেন না? অবশ্যই নেবেন। মিসির আলি ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর কাছে কেউ আসবে না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে অ্যাপ্রন গায়ে মাঝবয়েসি এক ডাক্তার এসে উপস্থিত। ডাক্তার আসার এটা সময় নয়। প্রথমত শুক্রবার, দ্বিতীয়ত দেড়টা বাজে, লাঞ্চ ব্রেক। ডিউটির ডাক্তাররাও এই সময় ক্যান্টিনে খেতে যান।
ডাক্তার সাহেব বল্লেন,’কেমন আছেন?’
মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, ‘ভাল থাকলে কি হাসপাতালে পড়ে থাকি?’
‘আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে ভাল আছেন। কাল রাত খুব খারাপ অবস্থায় ছিলেন। প্রবল ডেলিরিয়াম।’
‘আপনি রাতে এসেছিলেন?’
‘জি।’
‘চিনতে পারছি না। মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। গত রাতে কী ঘটেছে কিচ্ছু মনে নেই।’
ডাক্তারসাহেব চেয়ারে বসলেন। তাঁর শরীর বেশ ভারী। শরীরের সঙ্গে মিল রেখে গলার স্বর ভারী। চশমার কাচ ভারী। সবই ভারী-ভারী, তবুও মানুষটির কথা বলার মধ্যে সহজ হালকা ভঙ্গি আছে। এ-জাতীয় মানুষ গল্প করতে এবং শুনতে ভালবাসে। মিসির আলি বললেন,’ডাক্তার সাহেব, আমি আপনার জন্যেকী করতে পারি বলুন।’
‘একটা সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এই কেবিনটা ছেড়ে অন্য কেবিনে চলে যেতে পারেন।একজন মহিলা এই কেবিনে আসতে চাচ্ছেন।’
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি এই মুহূর্তে কেবিন ছেড়ে দিচ্ছি।’
‘এই মুহূর্তে ছাড়তে হবে না। কাল ছাড়লেও হবে।’
ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিসির আলি বললেন, ‘ভদ্রমহিলা বিশেষ করে এই কেবিনে আসতে চাচ্ছেন কেন?’
‘তাঁর ধারণা এই কেবিন খুব লাকি। কেবিনের নম্বর চারশোনয়। যোগ করলে হয় তেরো। তেরো নম্বরটি নাকি তাঁর জন্যে খুব লাকি। সৌভাগ্য সংখ্যা। নিউমোরলজির হিসাব।’
‘কী অদ্ভুত কথা!’
ডাক্তার সাহেব হালকা স্বরে বললেন, ‘অসুস্থ অবস্থায় মন দুর্বল থাকে। দুর্বল মনে তেরো নম্বরটি ঢুকে গেলে সমস্যা।’
‘মনের মধ্যে যা ঢুকেছে তা বের করে দিন।’
ডাক্তার সাহেব হেসে ফেলে বললেন, ‘এটা তো কোনো কাঁটা না রে ভাই যে চিমটা দিয়ে বের করে নিয়ে আসব। এর নাম কুসংস্কার। কুসংস্কার মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় ছড়িয়ে দেয়। কুসংস্কারকে তুলে ফেলাআমার মতো সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। যাই ভাই। আপনি তাহলে কাল ভোরে কেবিন নম্বর চারশো পাঁচে চলে যাবেন। কেবিনটা সিঁড়ির কাছে না, কাজেই হৈচৈ হবে না। তা ছাড়া জানালার ভিউ ভাল। গাছপালা দেখতে পারবেন।
মিসির আলিগম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি এই রুমছাড়ব না। এখানেই থাকব।’
ডাক্তার বিস্মিত হয়ে তাকালেন। কী একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মিসির আলি বললেন, ‘রুম ছাড়ব না, কারণ, ছাড়লে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। আমি এই জীবনে কুসংস্কার প্রশ্রয় দেবার মতো কোনো কাজ করিনি। ভবিষ্যতেও করব না।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আপনি যদি অন্য কোনো কারণ বলতেন, রুম ছেড়ে দিতাম। আমার কাছে চারশো নয় নম্বর যা, চারশো পাঁচও তা। তফাত মাত্র চারটা ডিজিটের।’
ডাক্তার সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘আপনি কি ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলবেন?’
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভদ্রমহিলা এ-ঘরে না আসা পর্যন্ত অপারেশন করাবেন না। অপেক্ষা করবেন। অথচ অপারেশনটা জরুরি।’
‘ওঁর অসুবিধা কী?’
‘কিডনির কাছাকাছি একটা সিস্টের মতো হয়েছে। আপনি যদি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন তা হলে ভাল হয়। ভদ্রমহিলাকে আপনি চেনেন।’
‘তা-ই নাকি?’
‘হ্যাঁ। ভাল করেই চেনেন। উনি অনুরোধ করলে না বলতে পারবেন না।’
‘নাম কী তাঁর?’
‘আমি ওঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি কথা বলুন।’
মিসিরআলি তাকিয়ে আছেন।
দরজা ধরে যে-মহিলা দাঁড়িয়ে তারবয়স ত্রিশের কাছাকাছি হলেও তাকে দেখাচ্ছে বালিকার মতো। লম্বাটে মুখ, কাটা-কাটা চেহারা। অসম্ভব রূপবতী। সাধারণত রূপবতীরা মানুষকে আকর্ষণ করে না- একটু দূরে সরিয়ে রাখে। এই মেয়েটির মধ্যে আকর্ষণী-ক্ষমতা প্রবল।মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি বলল, ‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘না।’
‘সে কী, চেনা উচিত ছিল তো! আপনি সিনেমা দেখেন না নিশ্চয়ই?’
‘না।’
‘টিভি? টিভিও দেখেন না? টিভি দেখলেও তো আমাকে চেনার কথা!’
‘আমার টিভি নেই। বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে অবশ্যি মাঝে মাঝে দেখি। আপনি কি কোনো অভিনেত্রী?’
‘হ্যাঁ। এলেবেলে টাইপ অভিনেত্রী নই। খুব নামকরা। রাস্তায় বের হলে “ট্রাফিক জ্যাম” হয়ে যাবে।’
মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিতে মিসির আলি হেসে ফেললেন। মেয়েটিও হাসল। অভিনেত্রীর মাপা হাসি নয়। অন্তরঙ্গ হাসি। সহজ-সরল হাসি।
‘আপনি কিন্তু এখনও আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি।’
‘কী নাম?’
‘আসমানি । এটা আমার আসল নাম। সিনেমার জন্যে আমার ভিন্ন নাম আছে। সেই নাম আপনার জানার দরকার নেই। ভেতরে আসব?’
‘আসুন।’
মেয়েটি ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল। গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর করে বলল,‘শুনলাম আপনি নাকি কুসংস্কার সহ্য করতে পারেন না।’
‘ঠিকই শুনেছেন। সহ্য করি না এবং প্রশ্রয় দিই না।’
কুসংস্কার টুসংস্কার কিছু না। আপনি আপনার ঘরটা আমাকেছেড়ে দিন। আমার এই কেবিন খুব পছন্দ। আমি আপনার কাছেহাতজোড় করছি। প্লীজ!’
মেয়েটি সত্যি সত্যি হাতজোড়করল। মিসির আলি লজ্জায় পড়ে গেলন। একী কাণ্ড!
‘আমিএক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছি। হাতজোড় করতে হবে না।’
‘থ্যাংকস!’
‘থ্যাংকস বলারও প্রয়োজন নেই, তবে আমার ধারণা এই কেবিনটিতেও শেষ পর্যন্ত আপনি থাকতে রাজি হবেন না।’
‘এরকম মনে হবার কারণ কী?’
‘আপনি রাতে যখন ঘুমুতে যাবেন তখন হঠাৎ করে দেয়ালের একটা লেখা আপনার চোখে পড়বে – সবুজ মার্কারে কাঁচা কাঁচা হাতে লেখা –
এই ঘরে যে থাকবে
সে মারা যাবে।
ইহা সত্য, মিথ্যা নয়।
লেখা পড়েই আপনি আঁতকে উঠবেন। যেহেতু আপনারমন খুব দুর্বল সেহেতু আপনি আর এখানে থাকবেন না।’
আসমানি বলল, ‘কোথায় লেখাটা দেখি?’
তিনি লেখাটা দেখালেন। আসমানি বলল, কে লিখেছে?’
মিসির আলি থেমে থেমে বললেন, ‘যে লিখেছে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, তবে আমি অনুমান করতে পারি, একটি বাচ্চা মেয়ের লেখা। মেয়েটির উচ্চতা চারফুট দুইঞ্চি। এবং মেয়েটি এই ঘরেই মারা গেছে।’
আসমানি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এসব আপনার অনুমান?’
‘জি, অনুমান। তবে যুক্তিনির্ভর অনুমান।’
‘যুক্তিনির্ভর অনুমান মানে?’
‘এক এক করে বলি। এটাএকটা মেয়ের লেখা তা অনুমান করছি দেয়ালে আঁকা কিছু ছবি দেখে। সবুজ মার্কারে আঁকা বেশকিছু ছবি আছে, সবই বেণি বাঁধা বালিকাদের ছবি। মেয়েরা একটা বয়স পর্যন্ত শুধু মেয়েদের ছবি আঁকে।’
‘তা-ই বুঝি?’
‘হ্যাঁ, তা-ই। মেয়েটির উচ্চতা আঁচ করেছি আরও সহজে। আমরা যখন দেয়ালে কিছু লিখি তখন লিখি চোখ বরাবর। মেয়েটি বিছানায়বসে বসে লিখেছে। সেখান থেকে তার উচ্চতা আঁচ করলাম।’
‘দাঁড়িয়েও তো লিখতে পারে। হয়তো মেঝেতে দাঁড়িয়ে লিখেছে।’
‘তা পারে। তবে মেয়েটি অসুস্থ। বিছানায় বসে বসে লেখাই তার জন্যে যুক্তিসঙ্গত।’
আসমানি গম্ভীর গলায় বলল, ‘মেয়েটি যে বেঁচে নেই তা কী করে অনুমান করলেন?’ কাউকে জিজ্ঞেস করেছেন?’
‘না, কাউকে জিজ্ঞেস করিনি। এটাও অনুমান। বাচ্চারা দেয়ালে লেখার ব্যাপারেখুবই পার্টিকুলার। যা বিশ্বাস করে তা-ই সে দেয়ালে লেখে। যদি বাচ্চাটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যেত তা হলে অবধারিতভাবে এই লেখার জন্যে সে লজ্জিত বোধ করত, এবং হাসপাতাল ছেড়ে যাবার আগে লেখাটি নষ্ট করে যেত।’
‘আপনি কী করেন জানতে পারি?’
‘মাস্টারি করতাম, এখন করি না। পার্ট টাইম টিচার ছিলাম। অস্থায়ী পোস্ট। চাকরি চলে গেছে।’
‘আপনি আমাকে দেখে কি আমার সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?’
‘একটা সামান্য কথা বলতে পারি – আপনার ডাকনাম আসমানি নয় – অন্যকিছু।’
‘এরকম মনে হবার কারণ কী?’
‘আসমানি নামটি আপনি এমনভাবে বললেনযাতে আমার কাছে মনে হল অচেনা একটি শব্দ বলছেন। তার চেয়েও বড় কথা আপনার পরনে আসমানি রঙের একটি শাড়ি। শাড়িটি পরার পর থেকেই হয়তো আসমানি নামটি আপনার মাথায় ঘুরছে। প্রথম সুযোগে এই নামটি বললেন।’
‘আমার ডাক নামবুড়ি।’
মিসির আলি কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বুড়ি বলল, ‘আপনি অনুমানগুলি কীভাবে করেন?’
‘লজিক ব্যবহার করে করি। সামান্য লজিক। লজিক ব্যবহার করার ক্ষমতা সবার মধ্যেই আছে। বেশির ভাগ মানুষই তা ব্যবহার করে না। যেমন আপনি ব্যবহার করছেন না। ভেবে বসে আছেন চারশো নয় নম্বর ঘরটি আপনার জন্যে লাকি। এরকম ভাবার পেছনে কোন লজিক নেই।’
‘লজিকই কি এই পৃথিবীর শেষ কথা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে লজিকই হচ্ছে পৃথিবীর শেষ কথা। লজিকের বাইরে কিছু নেই? পৃথিবীর সমস্ত রহস্যের সমাধান আছে লজিকে, পারবেন বলতে?’
‘পারব।’
‘ভাল কথা। শুনে খুশি হলাম। আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?’
‘আমার নাম মিসির আলি। আপনি কি কাল ভোরে এই কেবিনে আসতে চান? না মত বদলেছেন?’
‘আমি কাল ভোরে চলে এসব। যাই মিসির আলি সাহেব। স্লামালিকুম।’
মেয়েটি নিজের কেবিনে ফিরে গেল। রাত দশটার ভেতর চারশো নয় নম্বর কেবিনে আগের রোগীর যাবতীয় তথ্য জোগাড় করল। এই কেবিনে ‘লাবণ্য’ নামের দশ বছর বয়েসি একটি মেয়ে থাকত। হার্টের ভাল্বের কী একটা জটিল সমস্যায় সে দীর্ঘদিন এই ঘরটিতেছিল। মারা গেছে মাত্র দশদিন আগে। তার ওজন তেষট্টি পাউণ্ড। উচ্চতা চার ফুট এক ইঞ্চি।
মিসির আলি সাহেবসামান্য ভুল করেছেন? তিনি বলেছেন চার ফুট দুইঞ্চি। এইটুকু ভুল বোধহয় ক্ষমা করা যায়।
চারশো ন নম্বর কেবিনের ভোল পুরোপুরি পালটে গেছে। দেয়াল ঝকঝক করছে। কারণ প্লাস্টিক পেইন্ট করা হয়েছে। অ্যাটাচড বাথরুমের দরজায় ঝুলছে হালকা নীল পর্দা। বাথরুমের কমোডের ফ্ল্যাশ ঠিক করা হয়েছে। পানির ট্যাপও সরানো হয়েছে। মেঝেতে পানি জমে থাকত – এখন পানি নেই।
কেবিনের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বুড়ি বিছানায় শুয়ে শুয়েগভীর মনযোগে খাতায় কীসব লিখছে। লেখার ব্যাপারটি যে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছে বাংলা অভিধান দেখে। সে মাঝেমাঝেই অভিধান দেখে নিচ্ছে। লেখার গতি খুব দ্রুত নয়। কিছুক্ষণ পর পরই খাতা নামিয়ে রেখে তাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম করতে দেখা যাচ্ছে।এই সময় টেবিল-ল্যাম্পটি সে নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে। টেবিল-ল্যাম্পটা খুব সুন্দর। একটিমাত্র ল্যাম্প ঘরের চেহারা পালটে দিয়েছে।
বুড়ি লিখছে –
গত পরশু মিসির আলি নামের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। পরিচয় বলা ঠিক হচ্ছে না – কারণ আমি তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। তিনিও আমার সম্পর্কে কিছু জানেন না। মানুষটি বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই এটা চমৎকার একটা গুণ। কিন্তু তাঁর দোষ হচ্ছে তিনি একই সঙ্গে অহংকারী। অহংকার, বুদ্ধির কারণে, যেটা আমার ভাল লাগেনি। বুদ্ধির খেলা দেখিয়ে তিনি আমাকে অভিভূত করতে চেয়েছেন। কেউআমাকে অভিভূত করতে চাইলে আমার ভাল লাগে না। রাগ হয়।বয়স হবার পর থেকেই দেখছি আমার চারপাশে যারা আসছে তারাই আমাকে অভিভূত করতে চাচ্ছে। এক-একবার আমার চেঁচিয়ে বলার ইচ্ছা হয়েছে – হাতজোড় করছি, আমাকে রেহাই দিন।আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। পৃথিবীতে অসংখ্য মেয়ে আছে যাদের জন্মই হয়েছে অভিভূত হবার জন্যে। তাঁদের কাছেযান। তাদের অভিভূত করুন, হোয়াই মী?
এই কথাগুলি আমি মিসির আলি সাহেবকে বলতে পারলে সবচে’ খুশি হতাম- তাঁকে বলতে পারছি না। কারণ উনি আমাকে সত্যি সত্যি অভিভূত করেছেন। চমকে দিয়েছেন। ছোট বালিকারা যেমন ম্যাজিকদেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয় আমার বেলাতে তা-ই হয়েছে।আমি হয়েছি বাক্যহারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার এই বিস্ময়কে তিনি মোটেই পাত্তা দিলেন না। ম্যাজিশিয়ানরাঅন্যের বিস্ময় উপভোগ করে। তিনি করেননি।
সবুজ রঙেরদেয়ালের লেখা প্রসঙ্গে যখন আমি যা জেনেছি তা তাঁকে বলতে গেলাম, তিনি কোনো আগ্রহ দেখালেন না। আমি যখন তাঁর বিছানার পাশের চেয়ারে বসলাম, তিনি শুকনো গলায় বললেন – কিছু বলতে এসেছেন?’
আমি বললাম, না। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
তিনি বললেন, ও । তাঁর চোখমুখ দেখেই মনে হল, তিনি বিরক্ত, মহাবিরক্ত। নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছেন না। চেয়ারে বসেছি, চটকরে উঠে যাওয়া ভাল দেখায় না। কাজেই মিসির আলি সাহেবের অসুখটা কী, কতদিন ধরে হাসপাতালে আছেন এই সম্পর্কেকয়েকটা প্রশ্ন করলাম। তিনি নিতান্তই অনাগ্রহে জবাব দিলেন। আমি যখন বললাম, আচ্ছা তা হলে যাই? তিনি খুবই আনন্দিত হলেন বলে মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। ‘আবার আসবেন’ এই সামান্য বাক্যটি বললেন না। এটা বলাটাই স্বাভাবিক ভদ্রতা।
তাঁর ঘর থেকে ফিরে আমার বেশ কিছু সময় মন-খারাপ রইল। আমার জন্যে এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। আমার এক ধরনের ডিফেন্স মেকানিজম আছে – অন্যের ব্যবহারে আমি কখনো আহত হই না – কারণএসবকে আমি ছেলেবেলা থেকেই তুচ্ছ করতে শিখেছি।
মিসির আলি সাহেব আমার কিছু উপকার করেছেন, তাঁর নিজের কেবিন ছেড়ে দিয়েছেন। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে তিনি আমাকে অপমান করতে পারেন না। এই অধিকার তাঁর নেই। ঘণ্টা দুই আগে তিনি যা করলেন তা অপমান ছাড়া আর কি? উনি রেলিং ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ব্লাড ম্যাচিং নাকি কী হাবিজাবি করে উপরে এসেছি। আমার পায়ের শব্দে তিনি তাকালেন। আমি বললাম, ভাল আছেন? তিনি কিছু বললেন না। তাকিয়েই রইলেন। আমি বললাম, চিনতেপারছেন তো? আমি বুড়ি । তিনি বললেন, ও আচ্ছা।
‘ও আচ্ছা’ কোনো বাক্য হয়? এত তাচ্ছিল্য করে কেউ কখনো আমাকে কিছু বলেনি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার উচিত ছিলআর কোনো কথা না বলে নিজের কেবিনে চলে আসা। তা না করে আমি গায়ে পড়ে বললাম, আজ আপনার শরীরটা মনে হয় ভাল, হাঁটাহাঁটি করছেন। তাঁর উত্তরে তিনি আবারও বললেন – ওআচ্ছা ।
তার মানে হচ্ছে আমি কী বলছি তা নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই। দায়সারা ‘ও আচ্ছা’ দিয়ে সমস্যাসমাধান করছেন। আমি তো তাঁকে বিরক্ত করার জন্যে কিছুবলিনি। আমি কাউকে বিরক্ত করার জন্যে কখনো কিছু করি না। উলটোটাই সব সময় হয়। লোকজন আমাকে বিরক্ত করে। ক্রমাগত বিরক্ত করে।
মিসির আলি নামের আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধিমান এই মানুষটি আমাকে অপমান করছেন। কে জানে হয়তো জেনেশুনেই করছেন। মানুষকে অপমান করার সূক্ষ্ম পদ্ধতি সবার জানা থাকে না, অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান মানুষরাই শুধু জানেন এবং অকারণে প্রয়োগ করেন। সে সুযোগ তাঁদের দেয়া উচিত না। আমি শীতল গলায় বললাম, মিসির আলি সাহেব!
উনি চমকে তাকালেন। আমি বললাম, ঠিক করে বলুন তো আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘চিনব না কেন?’
‘আমি যা-ই জিজ্ঞেস করছি আপনি বলছেন – “ও আচ্ছা” । এরকারণটা কি আপনি আমাকে বলবেন?’
‘আপনি কী বলছেন আমি মন দিয়ে শুনিনি। শোনার চেষ্টাও করিনি। মনে হয় সেজন্যেই “ও আচ্ছা” বলছি।’
‘কেন বলুন তো?’
‘আমি প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। এই উপসর্গ নতুন হয়েছে, আগে ছিল না। আমি মাথাব্যথা ভুলে থাকার জন্যে নানানকিছু ভাবছি। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি।’
আমি বললাম, মাথাব্যথার সময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম, কিন্তু ভদ্রলোকের মাথাব্যথার গল্প বিশ্বাস করলামনা। প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে এমন শান্ত ভঙ্গিতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না। এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথায় এত সুন্দর যুক্তিভরা কথাও মনে আসে না। ভদ্রলোকের মানসিকতা কী তা মনে হয় আমি আঁচ করতে পারছি। কিছু-কিছু পুরুষ আছে যারা রূপবতী তরুণীদের অগ্রাহ্য করে একধরনের আনন্দ পায়। সচরাচর এরা নিঃসঙ্গ ধরনের পুরুষ হয়, এবং নারীসঙ্গের জন্যে বাসনা বুকে পুষে রাখে।
মিসির আলি সাহেব যে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ তা এই দুদিনে আমি বুঝে ফেলেছি।এই ভদ্রলোককে দেখতে কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এখন পর্যন্ত আসেনি। আমাদের দেশে গুরুতর অসুস্থ একজনকে দেখতে কেউ আসবে না তা ভাবাই যায় না। একজন কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তার আত্মীয়স্বজন আসে, বন্ধুবান্ধবআসে, পাড়া-প্রতিবেশী আসে, এমনকি গলির মোড়ের যে মুদিদোকানি সেও আসে-এটা একধরনের সামাজিক নিয়ম। মিসির আলির জন্যে কেউ আসছে না।
অবশ্যি আমাকে দেখতেও কেউ আসছে না । আমার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায়। আমি কাউকেই কিছু জানাইনি। যারা জানে তাদের কঠিনভাবে বলা হয়েছে তারা যেন আমাকে দেখতে না আসে। তারা আসছে না, কারণ আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করলে তাদেরই সমস্যা।
আচ্ছা, আমি এই মানুষটিকে নিয়ে এত ভাবছি কেন? নিতান্ত অপরিচিতএকজন মানুষকে নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করার কোনো মানে হয়! আমি নিজে নিঃসঙ্গ বলেই কি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতি মমতা বোধ করছি?
ভদ্রলোক আমার প্রতি অবহেলা দেখিয়েছেন আমি তাতে কষ্ট পাচ্ছি। আমরা অতি প্রিয়জনদেরঅবহেলাতেই কষ্ট পাই। কিন্তু এই ভদ্রলোক তো আমার অতিপ্রিয় কেউ নন। আমরা দুজন দুপ্রান্তের মানুষ। তাঁর জগৎ ভিন্ন, আমার জগৎ ভিন্ন। হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবার পর আর কখনো হয়তো তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে না।
আমারকেন জানি মনে হচ্ছে এই হাসপাতালে যে-কটা দিন আছি সেই কটা দিন ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্পটল্প করলে আমার ভাল লাগবে। কারও সঙ্গেই কথা বলে আমি আরাম পাই না। যার সঙ্গেই কথা বলি আমার মনে হয় সে ঠিকমতো কথা বলছে না। ভানকরছে। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছে। যেন সে পৃথিবীর সবচে’ জ্ঞানী মানুষ। সে ধরেই নিচ্ছে তার কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে আমি মনেমনে তার সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা করছি, অথচ আমি যে মনেমনে অসংখ্যবার বলছি হাঁদারাম,হাঁদারাম, তুই হাঁদারাম, সেই ধারণাও তার নেই।
মিসির আলি নিশ্চয়ই সেরকম হবেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিশ্চয়ই আমি কখনো মনেমনে বলব না – ‘হাঁদারাম’ ।আমার নিজের একটি নিতান্তই ব্যক্তিগত গল্প আছে যা আমি খুব কম মানুষকেই বলেছি। এই গল্পটাও হয়তো আমি তাঁকেবলতে পারি। আমার এই গল্প আমি যাঁদেরকে বলেছি তাঁদেরসবাই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন, তারপর বলেছেন – আপনারমানসিক সমস্যা আছে। ভাল কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেযান।
মানুষ এই এক নতুন জিনিশ শিখেছে, কিছু হলেই সাইকিয়াট্রিস্ট। মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট সেই এলোমেলো মাথা ঠিক করে দেবেন। মানুষের মাথা কিএমনই পলকা জিনিস যে সামান্য আঘাতেই এলোমেলো হয়ে যাবে? এই কথাটিও মিসির আলি সাহেবকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। ভদ্রলোক মাস্টার-মানুষ, কাজেই ছাত্রীর মতো ভঙ্গিতে খানিকটা ভয়ে ভয়ে যদি জিজ্ঞেস করা যায়- আচ্ছা স্যার, মানুষের মাথা এলোমেলো হবার জন্যে কত বড় মানসিক আঘাতের প্রয়োজন? তখন তিনি নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের জবাব দেবেন। সে জবাবের গুরুত্ব থাকবে। কারণ মানুষটির ভেতর লজিকের অংশ বেশ শক্ত।
বুড়ি বলল, ‘স্যার আসব?’
মিসির আলি বিছানায় কাত হয়ে বই পড়ছিলেন – বইটির নাম লেখক – ‘Mysteries of afterlife’ লেখক F. Smyth. মজার বই। মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে এমনসব বর্ণনা আছে যা পড়লে মনে হয় লেখকসাহেব ঐজগৎ ঘুরে এসেছেন। বেশ কিছুদিন সেখানে ছিলেন। ভালমতোসবকিছু দেখা। এজাতীয় লেখা হয়, ছাপা হয় এবং হাজার হাজার কপি বিক্রি হয় এটাই এক বিস্ময়।
তিনি বই বন্ধ করে বুড়ির দিকে তাকালেন। মেয়েটির সঙ্গে বেশ কয়েকবার তাঁর দেখা হয়েছে। মেয়েটির ভাবভঙ্গিতে মনে হয় তাঁর সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে সে এক ধরনের আগ্রহবোধ করছে। আগ্রহের কারণ স্পষ্ট নয়। তার কি কোনো সমস্যা আছে? থাকতে পারে।
মিসির আলি এই মুহূর্তে অন্যের সমস্যা নিয়ে ভাবতে চাচ্ছেন না। তাঁর নিজের সমস্যাই প্রবল। শারীর-সমস্যা। ডাক্তাররা অসুখের ধরন এখনও ধরতে পারছেন না। বলেছেন যকৃতের একটা অংশ কাজ করছে না। যকৃত মানুষের শরীরের বিশাল এক যন্ত্র। সেই যন্ত্রের অংশবিশেষ কাজ না করলেও অসুবিধা হবার কথা না। তা হলে অসুবিধা হচ্ছে কেন? মাথার যন্ত্রণাই – বা কেন হচ্ছে? টিউমার জাতীয় কিছু কি হয়ে গেল? টিউমার বড় হচ্ছে – মস্তিষ্কে চাপ দিচ্ছে। সেই চাপটা শুধু সন্ধার পর থেকে দিচ্ছে কেন?
বুড়ি আবার বলল, ‘স্যার, আমি কি আসব?’
মেয়েটিরপরনে প্রথম দিনের আসমানি রঙের শাড়ি। হয়তো এই শাড়িটাই তাঁর ‘লাকি শাড়ি’। অপারেশন টেবিলে যাবার আগে সে বলবে – আমাকে এই লাকি শাড়িটা পরতে দিন। প্লীজ ডাক্তার,প্লীজ!
রাত আটটা প্রায় বাজে। এমন কিছু রাত নয়, তবু মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি তার পরেও বললেন, ‘আপনার কি মাথাধরাআছে?’
‘এখন নেই। রোজই সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়। আজ এখনও কেন যে শুরু হচ্ছে না বুঝতে পারছি না।’
বুড়ি হাসতে হাসতে বলল, ‘মনে হচ্ছে মাথা না ধরায় আপনার মন খারাপ হয়ে গেছে। স্যার, আমি কি বসব?’
‘বসুন বসুন। আমাকে স্যার বলছেন কেন তা বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি শিক্ষক-মানুষ এইজন্যেই স্যার বলছি। ভাল শিক্ষক দেখলেই ছাত্রী হতে ইচ্ছা করে।’
‘আমি ভাল শিক্ষক আপনাকেকে বলল?’
‘কেউ বলেনি। আমার মনে হচ্ছে। আপনি কথা বলার সময় খুব জোর দিয়ে বলেন। এমনভাবে বলেন যে যখন শুনি মনে হয় আপনি যা বলছেন তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই বলছেন। ভাল শিক্ষকের এটা হচ্ছে প্রথম শর্ত।’
‘দ্বিতীয় শর্ত কি?’
‘দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে জ্ঞান। ভাল শিক্ষকের প্রচুর জানতে হবে এবং ভালমতো জানতে হবে।’
‘আপনি নিজেও কিন্তু শিক্ষকের মতো কথা বলছেন।’
বুড়ি বলল, ‘আমার জীবনের ইচ্ছা কী ছিল জানেন? কিণ্ডারগার্ডেনের শিক্ষিকা হওয়া। ফ্রক-পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েঘুরে বেড়াবে, আমি তাদের পড়াব, গান শেখাব। ব্যথা পেয়ে কাঁদলে আদর করব। অথচ আমি কী হয়েছি দেখুন – একজন অভিনেত্রী! আমার সমস্ত কর্মকাণ্ড বয়স্ক মানুষ নিয়ে। আমার জীবনে শিশুর কোনো স্থান নেই। স্যার, আমি কি বকবক করে আপনাকে বিরক্ত করছি?’
‘না, করছেন না।’
‘আপনি আমাকে তুমি করে ডাকলে আমি খুব খুশি হব। আপনি আমাকেতুমি করে ডাকবেন, এবং নাম ধরে ডাকবেন। প্লীজ!’
‘বুড়ি ডাকতে বলছ?’
‘হ্যাঁ, বুড়ি ডাকবেন। আমার ডাকনামটা বেশ অদ্ভুত না? যখন সত্যি সত্যি বুড়ি হব তখন বুড়ি বলে ডাকার কেউ থাকবে না।’
মিসির আলি বললেন, ‘তুমি কি সবসময় এমন গুছিয়ে কথা বল?’
‘আপনার কি ধারণা?’
‘আমার ধারণা তুমি কথা কম বল। যারা কথা বেশি বলে তারা গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না। যারা কম কথা বলে তারা যখন বিশেষ কোনো কথা বলতে চায় তখন খুব গুছিয়ে বলতে পারে। আমার ধারণা তুমি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছ।’
‘আপনার ধারণা সত্যি নয়। আমি আপনাকে বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছি না। আগামীকাল আমার অপারেশন। ভয়ভয় লাগছে। ভয় কাটানোর জন্যে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।’
‘ভয় কেটেছে?’
‘কাটেনি। তবে ভুলে আছি। আপনার এখান থেকে যাবার পর – গরম পানিতে গোসল করব। আয়াকে গরম পানি আনতে বলেছি। গোসলের পর কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েপড়ব।’
মিসির আলি হাই তুললেন। মেয়েটির কথা এখন আরশুনতে ভাল লাগছে না। তাকে বলাও যাচ্ছে না – তুমি এখন যাও, আমার মাথা ধরেছে। মাথা সত্যি সত্যি ধরলে বলা যেত। মাথা ধরেনি।
‘আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন স্যার?’
মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, ‘গল্পটা বলো।’
‘কোন গল্পটা বলব?’
‘কেউ যখন জানতে চায়, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন তখন তার মাথায় একটা ভূতের গল্প থাকে। ঐটা সে শোনাতে চায়। তুমিও চাচ্ছ।’
‘আপনি ভুল করেছেন। আমি আপনাকে কোনো গল্প শোনাতে চাচ্ছি না। কোনো ভৌতিক গল্প আমার জানা নেই।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আর একটাকথা, আপনি দয়া করে “ও আচ্ছা” বাক্যটা বলবেন না। এবংনিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করবেন না।’
‘বুড়ি, তুমি রেগে যাচ্ছ।’
‘আমাকে তুমি তুমি করেও বলবেন না।’
বুড়ি উঠে দাঁড়াল এবং প্রায় ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল প্রকৃতি শুধুমাত্র মেয়েদের মধ্যেই বিপরীত গুণাবলির দর্শনীয় সমাবেশ ঘটিয়েছে। মেয়েকে যেহেতু সবসময়ই সন্তানধারণ করতে হয় সেহেতু প্রকৃতি তাকে করল শান্ত, ধীর, স্থির। একই সঙ্গে ঠিক একই মাত্রায় তাকে করল অশান্ত, অধীর, অস্থির। প্রকৃতি সবসময়ই মজার খেলা খেলছে।
মিসির আলি বই খুললেন, মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে স্মিথ সাহেবের বক্তব্য পড়া যাক।
‘স্থুল দেহের ভেতরেই লুকিয়ে আছে মানুষের সূক্ষ্ম দেহ। সেই দেহকে বলে বাইওপ্লাজমিক বডি। স্থুল দৃষ্টিতে সেই দেহ দেখা যায় না। স্থুলদেহের বিনাশ হলেই সূক্ষ্ম দেহ বা বাইওপ্লাজমিক বডি – স্থুল দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। সূক্ষ্ম দেহ শক্তিরমতো। শক্তির যেমন বিনাশ নেই – সূক্ষ্ম দেহেরও তেমন বিনাশ নেই। সূক্ষ্ম দেহের তরঙ্গ-ধর্ম আছে। তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য, স্থুল দেহের কামনা-বাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত। যার কামনা-বাসনা বেশি তার তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য তত বেশি।’
হিমু এক নতুন জগৎ
Post a Comment