আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)
আলবার্ট আইনস্টাইন
(১৮৭৯-১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)
জার্মানির একটি ছোট শহর উলমে এক সম্ভ্রান্ত ইহুদী পরিবারে আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চে। পিতা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি প্রায়ই ছেলেকে নানান খেলনা এনে দিতেন। শিশু আইস্টাইনের বিচিত্র চরিত্রকে সেই দিন উপলদ্ধি করা সম্ভব হয়নি, স্কুলের শিক্ষকদের কাছে থেকে মাঝে মাঝেই অভিযোগ আসত-পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়া ছেলে, অমনোযোগী আনমনা। ক্লাশের কেউ তাঁর সঙ্গী ছিল না। সকলের শেষে পেছনের ব্রেঞ্চে গিয়ে বসতেন। শুধু তাঁর একমাত্র সঙ্গী তাঁর মা। তাঁর কাছে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের নানান সুর শোনেন। আর বেহালায় সেই সুর তুলেন। নিজের কারখানা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। আনন্দেই কাটছিল তাঁর জীবন। সেই আনন্দে ভরা দিনগুলোর মাঝে হঠাৎ কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। নিজের সেই শৈশবেই আইনস্টাইন প্রথম অনুভব করলেন জীবনের তিক্ত স্বাদ। তাঁরা ছিলেন ইহুদী। কিন্তু স্কুলে ক্যাথলিক ধর্মের নিয়মকানুন মেনে চলতে হত। স্কুলের সমস্ত পরিবেশটাই বিস্বাদ হয়ে যায় তাঁর কাছে। সঙ্গী নেই, বন্ধু নেই। তাই মনের নিঃসঙ্গতা ভুলতে আশ্রয় নিলেন বই-এর মধ্যে। দর্শনের বই তাঁকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত। পনের বছরের মধ্যে তিনি কান্ট, স্পিনোজা, ইউক্লিড, নিউটনের রচনা পড়ে শেষ করে ফেললেন। অবসর সময়ে বেহালায় সুর তুলতেন। এটাই ছিল তাঁর সঙ্গী-বন্ধু জগৎ। এই সময় বাবার ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিল। তিনি (আইনস্টাইনের বাবা) স্থির করলেন মিউনিখ ছেড়ে মিলানে চলে যাবেন, তাতে যদি ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। সকলে মিউনিখ ত্যাগ করল, শুধু সেখানে একা রয়ে গেলেন আইনস্টাইন। সুইজারল্যান্ডের একটি পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি হলেন। প্রথমবার তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পরীক্ষা পাশ করলেন। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে আসছে। আইনস্টাইন অনুভব করলেন সংসারের দায়-দায়িত্ব তাঁকে গ্রহণ করতেই হবে। শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করাবার জন্য তিনি পদার্থবিদ্যা ও গণিত নিয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করলেন। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে শিক্ষকতার জন্য বিভিন্ন স্কুলে দরখাস্ত করতে আরম্ভ করলেন। অনেকের চেয়েই শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি ছিল কিন্তু কোথাও চাকরি পেলেন না। কারণ তাঁর অপরাধ তিনি ইহুদী। নিরুপায় আইনস্টাইন খরচ চালাবার প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াতে আরম্ভ করলেন। এই সময় আইনস্টাইন তাঁর স্কুলের সহপাঠিনী মিলেভা মারেককে বিয়ে করলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২। মিলেভা শুধুমাত্র আইনস্টাইনের স্ত্রী ছিলেন না, প্রকৃত অর্থেই তাঁর জীবনসঙ্গী ছিলেন। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন শিক্ষকতার কাজ পাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় একটি অফিসে ক্লার্কের চাকরি নিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের খাতার পাতায় সমাধান করতেন অংকের জটিলতত্ব। স্বপ্ন দেখতেন প্রকৃতির দুর্জ্ঞেয় রহস্য ভেদ করবার। তাঁর এই গোপন সাধনার কথা শুধুমাত্র মিলেভাকে বলেছিলেন, ‘আমি এই বিশ্বপ্রকৃতির স্থান ও সময় নিয়ে গবেষণা করছি।’
আইনস্টাইনের এই গবেষণায় ছিল না কোন ল্যবরেটরি, ছিল না কোন যন্ত্রপাতি। তাঁর একমাত্র অবলম্বন ছিল খাতা-কলম আর তাঁর অসাধারণ চিন্তাশক্তি। অবশেষ শেষ হল তাঁর গবেষণা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬। একদিন ত্রিশ পাতার একটি প্রবন্ধ নিয়ে হাজির হলেন বার্লিনের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পত্রিকা ‘Annalen der Physik’-এর অফিসে। এই পত্রিকায় ১৯০১ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত আইনস্টাইন ৫টি রচনা প্রকাশ করলেন। এই সব রচনায় প্রচলিত বিষয়কে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে আইনস্টাইনের নাম বিজ্ঞনীমহলে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কোন সুরহ হল না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে বাড়িতে ছাত্র পড়াবার কাজ নিলেন। একদিকে অফিসের কাজ, সিলেভার স্নেহভরা ভালবাসা, অন্যদিগকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা। অবশেষে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিক তত্ব। বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত করল। এই অপেক্ষিকতা বলতে বুঝায় এক বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর তুলনা। আইনস্টাইন বেললেন, আমরা যখন কোন সময় বা স্থান পরিমাপ করি তখন আমাদের তা অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে হবে। তিনি বললেন, আলোক, বিশ্বজগৎ কাল এবং মাত্রা আপেক্ষিক।
আমাদের মহাবিশ্বে একটিমাত্র গতি আছে যা আপেক্ষিক নয়, একটি গতি আছে যা সর্বময় এক, অপর কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না, অন্য কোন গতির সঙ্গেও এর তুলনা হয় না। এই গতি হচ্ছে আলোকের গতি। এই গতি কখনই পরিবর্তন হয় না। এই সময় জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ জানালো আইনস্টাইনকে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেবার জন্য। ১৯০৭ সালে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন। এরই সাথে পেটেন্ট অফিসের চাকরিও করবেন। বিজ্ঞান জগতে ক্রমশই আইনস্টাইনের নাম ছড়িয়ে পড়ছিল। বিজ্ঞানী কেলভিনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেনাভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানানো হল। এখানে তাঁকে অনারির ডক্টরেট উপধি দেয়া হল। এরপর তাঁর ডাক এল জার্মানির সলসবার্গ কনফারেন্স থেকে। এখানে জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সামনে তাঁর প্রবন্ধ পড়লেন আইনস্টাইন। তিনি বললেন, তাত্বিক পদার্থবিদ্যার অগ্রগতির পরবর্তী পর্যায়ে আমরা এমন কোন এক তত্ব আবিষ্কার করব যা আলোর কণাতত্ব এবং তরঙ্গ তত্বকে সময়ের বাঁধনে বাঁধতে পারবে। আইনস্টাইনের এই উক্তির জবাবে বিজ্ঞানী প্লাঙ্ক বললেন, আইনস্টাইন যা চিন্তা করেছেন সেই পর্যায়ে চিন্তা করবার সময় এখনো আসেনি। এর উত্তরে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিক তত্বের E=mc স্কায়ার উৎপত্তিটি আলোচনা করে বোঝালেন, তিনি যা যা প্রমাণ করতে চাইছেন তা কতখানি সত্য। ১৯০৮ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন তাত্বিক পদার্থবিদ্যার পদ সৃষ্টি করা হল। রাজনৈতিক মহলের চাপে এই পদে মনোনীত করা হল আইস্টাইনের সহপাঠি ফ্রেডরিখ এডলারকে। ফ্রেডরিখ নতুন পদে যোগ দিয়েই জানতে পারলেন, তাঁকে আইনস্টাইনের পরিবর্তে নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি কর্তৃপক্ষকে জানালেন এই পদের জন্য আইনস্টাইনের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ নেই। তার তুলনায় আমার জ্ঞান নেহাতই নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও উপলদ্ধি করতে পারলেন ফ্রেডরিখের কথার গুরুত্ব। অবশেষে ১৯০৯ সালে আইনস্টাইনকে নতুন পদে নিয়োগ করা হল। অবশেষে আইনস্টাইন তার পেটেন্ট অফিসের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করলেন। জুরিখে এসে বাসা ভাড়া করলেন। আইনস্টাইন আর কেরানি নন, প্রফেসার। কিন্তু মাইনে আগে পেতেন ৪৫০০ ফ্রাঙ্ক, এখনো তাই। তবে লেকচার ফি বাবদ সামান্য কিছু বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগে বহু মানুষের সাথে, গুণী বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচয় হয়। এমন সময় ডাক এল জার্মানির প্রাগ থেকে। জার্মন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে তাঁকে নিয়োগপত্র দেয়া হল। মাইনে আগের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া প্রাগে গবেষণার জন্যে পাবেন বিশাল লাইব্রেরী। ১৯১১ সালে সপরিবারে প্রাগে এলেন আইনস্টাইন। কয়েক মাস আগে তাঁর দ্বিতীয় পু্ত্রের জন্ম হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ আকাঙ্খিত জুরিখের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক এল আইনস্টাইনের। ১৯১২ সালে প্রাগ ত্যাগ করে এলেন জুরিখে। এখানে তখন ছুটি কাটাতে এসেছিলেন মাদাম কুরি, সঙ্গে দুই কন্যা। বিজ্ঞানীর মধ্যে গড়ে উঠল মধুর বন্ধুত্ব। পাহাড়ি পথ ধরে যেতে যেতে মাদাম কুড়ি ব্যাখ্যা করেন তেজস্ক্রিয়তা আর আইনস্টাইন বলেন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ব। একদিন নিজের তত্বের কথা বলতে বলতে এত তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন, পথের ধারে গর্তের মধ্যে গড়িয়ে পড়লেন আইনস্টাইন। তাই দেখে মেরি কুরির দুই মেয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। গর্ত থেকে ওঠে তাদের সঙ্গে আইনস্টাইনও হাসিতে যোগ দিলেন। সেই সময় জার্মানিতে কাইজারের পৃষ্ঠপোষকতায় বার্লিন শহরে গড়ে উঠেছে কাইজার ভিলহেমস ইনষ্টিটিউট। বিজ্ঞানের এতবড় গবেষণাগার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখানে যোগ দিয়েছেন প্লাঙ্ক, নার্নষ্টি, হারের আরো সব বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা। কিন্তু অাইনস্টাইন না থাকলে যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সবকিছু। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হল। বার্লিনে এলেন আইনস্টাইন। সবকিছু দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি। শুধু গবেষণাগার নয়, বহু বিজ্ঞানীকেও কাছে পাওয়া যাবে। একসাথে কাজ করা যাবে। তাঁকে মাইনে দেয়া হল বর্তমান মাইনার দ্বিগুণ। ১৯১৪ সালে বার্লিনে এলেন আইনস্টাইন। যখন আইনস্টাইন বার্লিন ছেড়েছিলেন তখন তিনি পনেরো বছরের কিশোর। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ফিরে এলেন নিজের শহরে। চেনা-জানা পরিচিত মানুষদের সাথে দেখা হল। সবচেয়ে ভাল লাগল দুর সম্পর্কিত বোন এলসার সাথে দেখা হয়ে। বিধবা হয়ে নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে বাবার কাছে ফিরে এসেছে। এলসার সান্নিধ্য বরাবরই মুগ্ধ করত আইনস্টাইনকে। অল্পদিনেই অনেকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। ছেলেবেলা থেকেই যেখানে সেখানে অঙ্ক করার অভ্যাস ছিল আইনস্টাইনের। কখনো ঘরের মেঝেতে, কখনো টেবিলের উপর। টেবিল ভর্তি হয়ে গেলে মাটিতে বসে চেয়ারের উপরেই অঙ্ক কষে চলেছেন। আইনস্টাইন গবেষণায় যতই মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন, সংসারের প্রতি ততই উদাসীন হয়ে পড়ছিলেন। স্ত্রী মিলেভার সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ক্রমশই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল মিলেভা। দুই ছেলেকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে গেলেন। কয়েক মাস কেটে গেল আর ফিরলেন না মিলেভ। এদিকে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হল। বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই জড়িয়ে পড়লেন যুদ্ধে। আইনস্টাইন এই যুদ্ধের বীভৎসাতা দেখে ব্যথিত হলেন। এরই সাথে সংসারের একাকিত্ব। স্ত্রী পুত্রকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন আইনস্টাইন। এই সময় অসুস্থ আইনস্টাইনের পাশে এসে দাড়ালেন এলসা। এলসার অক্লান্ত সেবা-যত্নে ক্রমশই সুস্থ হয়ে উঠলেন আইনস্টাইন, এলসাকে বিয়ে করলেন। এদিকে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হল। কাইজারের পতন ঘটল, প্রতিষ্ঠা হল নতুন জার্মান রিপাবলিকের। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব তখনো প্রমাণিত হয়নি। এগিয়ে এলেন ইংরেজ বিজ্ঞানীরা। সূর্যগহণের একাধিক ছবি তোলা হল। সেই ছবি পরীক্ষা করে দেখা গেল আলো বাঁকে। বিজ্ঞানীরা উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন। মানুষ তার জ্ঞানের সীমানাকে অতিক্রম করতে চলেছে। অবশেষে ৬ নভেম্বর ইংল্যন্ডের রয়াল সোসাইটিতে ঘোষণা করা হল সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার, আলো বেঁকে যায়। এই বাঁকের নিয়ম নিউটনের তত্বে নেই। আলোর বাঁকের মাপ আছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রে। পরিহাসপ্রিয় আইনস্টইন তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে কৌতুক করে বললেন, আমার আপেক্ষিক তত্ব সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। এবার জার্মানী বলবে আমি জার্মান আর ফরাসীরা বলবে আমি বিশ্বনাগরিক। কিন্তু যদি আমার তত্ব মিথ্যা হত হাহলে ফরাসীরা বলত আমি জার্মান আর জার্মনরা বলত আমি ইহুদী। একদিন এক তরুণ সাংবাদিক বললেন, আপনি সংক্ষেপে বলুন আপেক্ষিক তত্বটা কি? আইনস্টাইন কৌতুক করে বললেন, যখন একজন লোক কোন সুন্দরীর সঙ্গে এক ঘন্টা গল্প করে তখন তার মনে হয় সে যেন এক মিনিট বসে আছে। কিন্তু যখন তাকে কোন গরম উনানের ধারে এক মিনিট দাঁড় করে দেয়া হয় তার মনে হয় সে যেন এ ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে। এই হচ্ছে আপেক্ষিক তত্ব। আপেক্ষিক তত্বে জটিলতার দুর্বোধ্যতার কারণে মুখরোচক কিছু কাহিনী ছড়িয়ে পড়ল। একদিন এক সুন্দরী তরুনী তার প্রেমিককে চার্চের ফাদারের সাথে পরিচয় করে দিল। পরদিন যখন মেয়েটি ফাদারের কাছে গিয়েছে, ফাদার তাকে কাছে ডেকে বললেন, তোমার প্রেমিককে আমার সবদিক থেকেই ভাল লেগেছে শুধু একটি বিষয় ছাড়া। মেয়েটি কৌতুহলে জিজ্ঞাসা করল, কোন জিনিসটি? ফাদার বললেন, তার কোন রসবোধ নেই। আমি তাকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের কথা জিজ্ঞেস করেছি, আর সে আমাকে তাই বোঝাতে আরম্ভ করল। হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটি।
আমেরিকার এক বিখ্যাত সুরকার জর্জ তাঁর এক বন্ধুকে বললেন, একজন মানুষ কুড়ি বছর ধরে একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করলেন, আর ভাবলে অবাক হতে হয় সেই চিন্তাটুকুকে প্রকাশ করলেন মাত্র তিন পাতায়। বন্ধুটি জবাব দিল, নিশ্চয়ই খুব ছোট অক্ষরে ছাপা হয়েছিল। আইনস্টাইন আমেরিকায় গিয়েছেন, সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরল। একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি এক কথায় আপেক্ষিক তত্বের ব্যাখ্যা করতে পারেন? আইনস্টাইন জবাব দিলেন, না। আজকাল মেয়েরা কেন আপেক্ষিক তত্ব নিয়ে এত আলোচনা করছে? আইনস্টাইন হাসতে হাসতে বললেন, মেয়ার সব সময়য়েই নতুন কিছু পছন্দ করে-এ বছরের নতুন জিনিস হল আপেক্ষিক তত্ব। অবশেষে এল। সাধক বিজ্ঞানীর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার। কিছুদিন ধরেই নোবেল কমিটি আইনস্টাইনকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার কথা চিন্তা করছিল। কিন্তু সংশয় দেখা গেল স্বয়ং নোবেলের ঘোষণার মধ্যে। তিনি বলে গিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যায় পুরষ্কার পাবেন আবিষ্কারক আর সেই আবিষ্কার যেন মানুষের কল্যাণে লাগে। আইনস্টাইনের বেলা বিতর্ক দেখা দিল তাঁর আপেক্ষি তত্ব যুগান্তকারী হলেও প্রত্যক্ষভাবে তা মানুষের কোন কাজে লাগবে না। তখন স্থির হল তাঁর ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট আবিষ্কারক হিসেবে পুরষ্কার প্রদান এবং এর প্রত্যক্ষ ব্যবহারও হচ্ছে, তাই ঘোষণা করা হল “ Service to the theory of Physics, especially for the Law of the Photo Electric Effect.” আইনস্টাইন তাঁর প্রথমা স্ত্রী মিলেভার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের শর্ত অনুসারে নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাই তাঁকে পাঠিয়ে দেন। আমেরিকায় বক্তৃতা দেবার জন্য বার বার ডাক আসছিল। অবশেষে ১৯৩০ সালে ডিসেম্বর মাসে তিনি যুক্তরাষ্ট গেলেন, সেখানে অভূতপূর্ব সম্মান পেলেন। শুধু আমেরিকা নয় যখন যে দেশেই যান সেখানেই পান সম্মান আর ভালবাসা। এদিকে স্বদেশ জার্মানী ক্রমশই আইনস্টাইনের কাছে পরবাস হয়ে উঠছিল। এদিকে তাঁর সাফল্য স্বীকৃতিকে দেশ জুড়ে এক জাতীয়তাবাদের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে একদল মানুষ। ইহুদীরা ক্রমশই ঘৃণিত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিবেবে পরিগণিত হতে থাকে। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন জার্মানীতে থাকা তাঁর পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু কোথায় যাবেন? অহ্বান আসে নানা দেশ থেকে। অবশেষে স্থির করলেন আমেরিকার প্রিন্সটনে যাবেন। জার্মনী থেকে ইহুদী বিতাড়ন শুরু হয়ে যায়। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন এবার তাঁরও যাবার পালা। প্রথমে গেলেন ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে ১৯৩৪ সালের ৭ জুলাই রওনা হলেন আমেরিকা। তখন তার বয়স পঞ্চান্ন। প্রিন্সটনের কর্তৃপক্ষ আইনস্টাইনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। গুপ্তঘাতকের দল যে সাগর পেরিয়ে আমেরিকায় এসে পৌঁছবে না তাই বা কে বলতে পারে। তই তাঁকে গোপন জায়গায় রাখা হল। সেই বাড়ির ঠিকানা কাউকে জানানো হল না। এইভাবে থাকতে তাঁর আর ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে ল্যাবরেটোরির থেকে এসে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। একদিন সন্ধ্যাবেলায় প্রিন্সটনের ডিরেকটরের থেকে এসে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। বাড়িতে ফোন এল, দয়া করে যদি আইনস্টাইনের বাড়ির নম্বরটা জানান। আইস্টাইনের বাড়ির নম্বর কাউকে জানানো হয় না বলে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন ডিরেকটর। খানিক পরে আবার ফোন বেজে উঠল। আমি আইনস্টাইন বলছি, বাড়ির নম্বর আর রাস্তা দুটোই ভুলে গিয়েছি। যদি দয়া করে বেলে দেন। এ এক বিচিত্র ঘটনা, যে মানুষটি নিজের ঘরের ঠিকানা মনে রাখতে পারেন না, তিনি বিশ্বপ্রকৃতির রহস্যের ঠিকানা খুঁজে বার করেন। প্রকৃতপক্ষে জীবনের উত্তরপর্বে এসে আইনস্টাইন হয়ে উঠেছিলেন গৃহ সন্ন্যাসী। বড়দের চেয়ে শিশুরাই তাঁর প্রিয়। তাদের মধ্যে গেলে সব কিছু ভুলে যান। শিশুদের কাছে কল্পনার খ্রীষ্টমাস বুড়ো। পরনে কোট নেই, টাই নেই, জ্যাকেট নেই, ঢলঢলে প্যান্ট আর গলা আঁটা সোয়েটার, মাথায় বড় বড় চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঝ্যাটা গোঁফ। দাড়ি কামাতে অর্ধেক দিন ভুলে যান। যখন মনে পড়ে গায়ে মাখা সাবানটা গালে ঘষে দাড়ি কেটে নেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে কি ব্যাপার গায়ে মাখা সাবন দিয়ে দাড়ি কাটা। আইনস্টাইন জবাব দিতেন, দু রকম সাবন ব্যবহার করে কি লাভ। শুধু নির্যাতিত ইহুদীদের সপক্ষে নয়, তিনি ক্রমশই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করছে দলমত নির্বিশেষে তিনি তাদের সমর্থন করলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন একদিন মানুষ এই ধ্বংসের উন্মাদনা ভুলে এক হবেই। আর একত্বতার মধ্যেই মানুষ খুঁজে পাবে ধর্মকে।
আইনস্টইনের কাছে এই ধর্মীয় চেতনা প্রচলিত কোন সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম মানবতারই এক মূর্ত প্রকাশ। বিজ্ঞান আর ধর্মে কোন প্রভেদ নেই। প্রভেদ শুধু দৃষ্টিভঙ্গিতে। বিজ্ঞান শুধু ‘কি’ তার উত্তর দিতে পারে ‘কেন’ বা ‘কি হওয়া উচিত’ সে উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। অপর দিকে ধর্ম শুধু মানুষের কাজ আর চিন্তার মূল্যায়ন করতে পারে মাত্র। সে হয়ত মানব জীবনের লক্ষ্য নির্ধরণ করতে পারে কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার পথ বলে দেয় বিজ্ঞান। তাই ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। মানবতাবাদী আইনস্টাইন একদিকে শন্তির জন্যে সংগ্রাম করছিলেন অন্যদিকে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে একের পর এক তত্ব আবিস্কার করছিলেন। এই সময় তিনি প্রধানত অভিকর্ষ ও বিদুৎ চৌম্বকক্ষেত্রের মিলন সাধনের প্রচেষ্টায় অতিবাহিত করেন। কোয়ান্টম বলবিদ্যার বিকাশের পথে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, কিন্তু এই তত্বের সম্ভাব্যতাভিত্তিক চরিত্রে তাঁর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল না। ১৯৩৬ সালে হঠাৎ স্ত্রী এলসা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুদীর্ঘ ষোল বছর ধরে এলসা ছিলেন আইনস্টাইনের যোগ্য সহধর্মিনী, তাঁর সুখ-দুঃখের সঙ্গী। আইনস্টাইন সব বুঝতে পারেন কিন্তু অসহায়ের মত তিনি শুধু চেয়ে থাকেন। অবশেষে ১৯৩৬ সালে চিরদিনের মত প্রিয়তম আইনস্টাইনকে ছেড়ে চলে গেলেন এলসা। এই মানসিক আঘাতে সাময়িকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন আইনস্টাইন। এই সময় পারমাণবিক শক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই শক্তির ভয়াবহতা সকলেই উপলদ্ধি করতে পারছিলেন। পরীক্ষায় জানা গেল পারমাণবিক শক্তি সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ধাতু হল ইউরেনিয়াম। আর এই ইউরেনিয়ম তখন একমাত্র পাওয়া যায় কঙ্গো উপত্যকায়। কঙ্গো বেলজিয়ামের অধিকারভুক্ত। বিজ্ঞানী মহলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল যদি জার্মানদের হাতে এই ইউরেনিয়াম পড়ে তাহলে তারা পরমানু বোমা তৈরিতে মূহুর্ত মাত্র বিলম্ব করবে না। গোপনে সংবাদ পাওয়া যায় জার্মান বিজ্ঞনীরা নাকি জোর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনস্টাইন উপলদ্ধি করলেন তাঁর সমীকরণ প্রমাণিত হতে চলেছে। সামন্য ভরের রূপান্তরের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে অপরিমেয় শক্তি। আইনস্টাইন লিখছেন, “আমার জীবনকেলে এই শক্তি পাওয়া যাবে ভাবতে পারিনি। এদিকে জার্মান বাহিনী দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীরা উপলদ্ধি করলেন, যুদ্ধ জয় করতে গেলে এটম বোমা তৈরি করা দরকার এবং তা জার্মানীর আগেই তৈরি করতে হবে। সকলে সমবেতভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে আবেদন জানাল। যদিও এই আবেদনপত্রে সই করেছিলেন আইনস্টাইন, আমেরিকায় পরমাণু বেমা তৈরির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই তিনি জড়িত ছিলেন না। শেষ দিকে তিনি চেয়েছিলেন এই গবেষণা বন্ধ হোক। তিনি বিজ্ঞানী মাক্স বোর্নকে বেলেন, পরমাণু বোমা তৈরির জন্য আবেদনপত্রে আমার সই করাটাই সবচেয়ে বড় ভুল। জাপানে এটম বেমা ফেলবার পর তার বিধ্বংসী রূপ দেখে বিচলিত হয়ে আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘পারমাণবিক শক্তি মানব জীবনে খুব তাড়াতাড়ি আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে-সে রকম মনে হয় না। এই শক্তি মানবজাতির প্রকৃতই ভয়ের কারণ হয়তো পরোক্ষভাবে তা ভালই করবে। ভয় পেয়ে মানবজাতি তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধের ক্ষেত্রে সুনির্ষিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা চালু করবে। ভয় ছাড়া মানুষ বোধ হয় কখনোই শান্তির পথে অগ্রসর হতে পারবে না। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হল তাঁর তত্ব (A generalised theory of Fravitation) মহার্কষের সর্বজনীন তত্ব। এত জটিল সেই তত্ব খুব কম সংখ্যক মানুষই তা উপলদ্ধি করতে পারলেন। যখন বিজ্ঞানীরা তাঁকে এই নতুন তত্ব নিয়ে আলোচনা করতে বললেন, তিনি সকৌতুকে বললেন, কুড়ি বছর পর এর আলোচনা করা যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে উঠেছে নতুন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানানো হল নতুন রাষ্টের রাস্ট্রপতি হবার জন্য। আইনস্টাইন জানালেন, প্রকৃতির তত্ব কিছু বুঝলেও মানুষ রাজনীতির কিছুই বোঝে না। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির পদ শুধুমাত্র শোভাবর্ধনের জন্য শোভা হলেও তাঁর বিবেক যা মানতে পারবে না তাকে তিনি কখনেই সমর্থন করতে পারবেন না। জীবন শেষ হয়ে আসছিল, এই সময়ে ইংরেজ মনীষী র্বাট্রেন্ড রাসেলের অনুরোধে বিশ্বশান্তির জন্য খসড়া লিখতে আরাম্ভ করলেন। কিন্তু শেষ করতে পারলেন না। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল তাঁর জীবন শেষ হল। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে মৃতদেহটি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হল। শোনা যায় পরীক্ষার জন্যে তাঁর ব্রেন কোন এক গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সমন্ধে কেউই আর কোন কথা প্রকাশ করেনি।
Post a Comment