Header Ads

test

চে গুয়েভারা  (১৯২৮-১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ)


চে গুয়েভারা 
(১৯২৮-১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ)

চে গুয়েভারা ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় তাত্ত্বিক মার্ক্সবাদী ও বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, চিত্রগ্রাহক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ ও কিউবার এবং পরবর্তীতে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)। তবে তিনি সারা বিশ্বে ‘চে’ নামেই পরিচিত। চে গুয়েভারার (অথবা গেভারা) জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন ।

ছোটবেলা থেকে এজমায় আক্রান্ত ছিলেন বলে তিনি হয়ে পড়েন ঘরকুনো আর প্রচণ্ড বই পাগল একজন মানুষ। ১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে সারাটা জীবন তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন বিশেষ করে পেবলো নেরুদা,জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লরকা, গ্যাব্রিয়ল মিনস্ট্রাল এবং ওয়াল্ট হুয়িটম্যান, তিনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। গুয়েভারা পরিবারে ছিল ৩০০০ এরও বেশি বই যা গুয়েভারাকে করে তোলে একজন জ্ঞান পিপাসু ও অক্লান্ত পাঠক; যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সলগারির বই পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, আলবার্ট ক্যামাস, লেনিন, রবার্ট ফ্রস্ট এর বইও তিনি পড়তেন।

চে গুয়েভারা ১৯৪৮ সালে বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে লেখাপড়ায় এক বছর বিরতি দিয়ে আলবার্টো গ্রানাডো নমক এক বন্ধুকে সাথে করে সেই ঘরকুনো 'চে' আদর্শের টানে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পেবলোর লেপার কলোনিতে (কুষ্ঠ রোগী দের জন্য বিশেষ কলোনি) স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে কয়েক সপ্তাহ কাজ করা| মাচুপিচ্চুর যাওয়ার পথে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের দারিদ্র কৃষকদের চরম দারিদ্রতা দেখে মর্মাহত হন। এ কৃষকরা ধনী মহাজনদের অধীনে থেকে ছোট ছোট জমিতে কাজ করত। তাঁর ভ্রমণের পরবর্তী সময়ে তিনি লেপার কলোনিতে বসবাসকারী মানুষের মাঝের ভ্রাতৃত্ব ও সাহচর্য দেখে অভিভূত হন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ডায়েরীতে (The Motorcycle Diaries,) তিনি লিখেছেন, ‘মানব সত্ত্বার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ রূপটি এসকল একাকী ও বেপরোয়া মানুষদের মাঝে জেগে উঠেছে’; তার এই দিনলিপি নিউয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার এবং পরে একই নামে (The Motorcycle Diaries) চলচ্চিত্রও বের হয়।

এই ভ্রমণ তাকে নিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও মিয়ামির মধ্য দিয়ে বুয়েন্স আয়রেস এর দিকে। ভ্রমণের শেষ দিকে তিনি এই মত পোষণ করেন যে দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি নয় বরং এক অভিন্ন অস্তিত্ব যার প্রয়জন মহাদেশ ব্যাপী স্বাধীনতার জাগরণ ও স্বাধীনতার পরিকল্পনা। পরবর্তিতে তাঁর নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে এই একক, সীমানাবিহীন আমেরিকার চেতনা ফিরে আসে বার বার|

১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে গেভারা মেক্সিকো শহরে পৌঁছান এবং সদর হাসপাতালে এলার্জি বিভাগে চাকুরি করেন। পাশাপাশি ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভির্সিটি অব মেক্সিকোতেমেডিসিন বিষয়ে প্রভাষক এবং লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তার বন্ধু নিকো লোপেজ রাউল কাস্ত্রোর সাথে তার পরিচয় করান এবং পরে তার বড় ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচিত হন। কাস্ত্রোর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তারপর তিনি ২৬শে জুলাই আন্দোলন দলের সদস্য হন। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন এই আগ্রাসী তত্পরতার আশু সমাপ্তি প্রয়োজন

বিপ্লবের পরিকল্পনায় কাস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালান। ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হন। তার ৮২ জন সহচরী মারা যান অথবা কারাবন্দী হয়, মাত্র ২২জন এ যাত্রায় বেঁচে যায়। গুয়েভারা লিখেছিলেন সেটা ছিল সেই রক্তক্ষয়ী মুখোমুখি সংঘর্ষের সময় যখন তিনি তার চিকিত্সা সামগ্রীর সাথে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়েছিলেন, যা তাকে পরিশেষে চিকিত্সক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে তাঁকে।

যুদ্ধচলাকালীন 'চে' বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অখণ্ড অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি এবং অধ্যবসায়ের কথা জানিয়ে ছিলেন। গুয়েভারা গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেঁকানোর জন্য চুল্লী প্রস্তুত এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা তৈরি করেন তাছাড়াও তিনি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণের কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রচার করতেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তিন বছর পর তাকে “কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক” বলে অ্যাখ্যায়িত করেছিল। তারপর তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান।

১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে কিউবার শিল্প বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় কিউবান নোটগুলোতে তার স্বাক্ষরে শুধু “চে” লেখা থাকতো। ১৯৬৫ সালে আলজিয়ার্স সফরকালে সোভিয়েত সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের দোসর আখ্যা দেয়ার ফলে দেশে ফেরার সাথে সাথে তার মন্ত্রীত্ব বাতিল হয়, এরপর তিনি বিপ্লবের পথে নিজেকে নিবেদিত করতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।

১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে গেভারা বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করার জন্য নিউইয়র্ক শহরে যান। ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে আবেগ অভিভূত বক্তৃতায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্যের কঠোরনীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন। এটাকে বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের কোন পদক্ষেপ আছে কি না জানতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন।

গুয়েভারা তখন নিগ্রো জনগণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রেরর নীতির কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ক্রোধান্বিত গুয়েভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লেরেশন অব হ্যাভানা’ নামক একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণার উল্লেখ করে তার বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন যে তার এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা। বক্তব্যের শেষ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, সারা বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিত্কার এখন, হয় স্বদেশ অথবা মৃত্যু।

১৯৬৫ সালে গেভারা আফ্রিকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং কঙ্গোয় চলমান যুদ্ধে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগাবার প্রস্তাব দেন। আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি আহমেদ বিন বেল্লার মতে, গুয়েভারা আফ্রিকাকে রাজতন্ত্রের দুর্বল ঘাটি ভেবেছিলেন। তাই সেখানে বিপ্লবের প্রচুর সম্ভাবনা তিনি দেখেছিলেন। মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের, ১৯৫৯ সালের সাক্ষাতের পর যার সাথে চে এর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি কঙ্গো আক্রমণের পরিকল্পনাকে বোকামি হিসেবে দেখেছিলেন। এই সতর্কতা সত্ত্বেও গুয়েভারা মার্কসবাদীদের সহায়তায় আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য তৈরি হন। ১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি, তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং ১২ জন সহচরী নিয়ে কঙ্গোয় পৌছান। তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেন। এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন।

গুয়েভারা অবস্থান সম্পর্কে তখন লোকজন জানত না। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৭ এর শুরুর দিকে জমবিক স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিনিধির সাথে ডার এস্ সালাম নামক স্থানে দেখা হয়। সেখানে গেভারা তাদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে হাভানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পদযাত্রায় এক মন্ত্রী বলেন যে 'চে' লাতিন আমেরিকার কোন জায়গায় বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তার পর প্রমানিত হয় যে তিনি বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কাস্ত্রোর আদেশে তিনি মন্টেন ড্রাই ফরেস্ট নামক দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষন চালান যেখানে বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিকরা তাকে সাহায্য করেছিল।

বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে তারা গুয়েভারাকে ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল বেলা ১.১০ টায়; মৃত্যুর এ সময়কাল এবং ধরণ নিয়ে মতভেদ এবং রহস্য এখনো আছে। ধারণা করা হয় ১৯৬৭ সালের এই দিনটিতে লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দী চে গুয়েভারাকে। পরে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী ঘোষণা করে যে বন্দী অবস্থায় নয়টি গুলি চালিয়ে সেই আর্জেন্টাইন ‘সন্ত্রাসবাদী’-কে মেরে ফেলতে পেরেছে এক মদ্যপ সৈনিক। তবে আরেকটি মতামত হচ্ছে এই দিন যুদ্ধে বন্দী হলেও তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় কিছুদিন পর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পরবর্তীতে এইসব দাবির স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।

এ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সে সময় লিখেছিল,‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ পরে ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণ-কবরে চে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। চে গেভারা মৃত্যুর আগে কিউবান ভাষায় লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ, ধারণা করা হয় ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় লিখেছেন আরও ২৫টি। এছাড়া তিনি লিখে দিয়েছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাতকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর কাছাকাছি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগৃহীত আছে ৭০টির মতো। তার লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলি। 

No comments