Header Ads

test

রানী ইসাবেলা


রানী ইসাবেলা

অজানা ভূ-খণ্ড আবিষ্কারের নেশায় আটলান্টিকের ঢেউয়ে জাহাজ ভাসিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। কিন্তু তাঁর কোনো অভিযানই সফল হচ্ছিল না। হতাশা এসে যখন তাকে আঁকড়ে ধরছিল, তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্পেনের রানী প্রথম ইসাবেলা। ইসাবেলার সাহায্য পেয়েই আবার নতুন করে জাহাজ ভাসালেন তিনি। এরপর ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কার করে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন কলম্বাস। কিন্তু কলম্বাসকে বিখ্যাত করার জন্য কিন্তু তাঁর পকেটে টাকা ঢালেননি রানী প্রথম ইসাবেলা। রানীর ইচ্ছা ছিল, নতুন কোনো মহাদেশ আবিষ্কারের মাধ্যমে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের বলয় আটলান্টিকের ওপার জুড়েও ছড়িয়ে দেবেন। প্রয়োজনে দাস হিসেবে বন্দি করে আনবেন সেদেশের আদিবাসীদের, আর কাজে লাগাবেন স্পেনের উন্নয়নের পথে। রানী ইসাবেলার এমন কয়েকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত স্পেন এবং লাতিন আমেরিকার পরবর্তী ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিল বিপুলভাবে। ঢেউ খেলানো বাদামি চুলের নীলনয়না এই সুদর্শনা রানী ১৪৫১ সালের ২২ এপ্রিল স্পেনের ম্যাডিরিগাল ডে লা টেরেসে জন্মগ্রহণ করেন। ইসাবেলার পিতা কাস্তিল রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় জন ১৪৫৪ সালে মারা যাওয়ার পর ইসাবেলার সৎ ভাই চতুর্থ হেনরি কাস্তিলের সিংহাসনে বসেন। ইসাবেলার বয়স তখন মাত্র তিন বছর। মা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন পর্তুগালে। ১৪৫৭ সাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থেকেই বড় হয়েছেন তিনি। এরপর চতুর্থ হেনরি আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসেন কাাস্তিলে। তিনি ধারণা করেছিলেন, পর্তুগালে থেকে ইসাবেলা এবং তাঁর ছোট ভাই আলফনসো একসময় তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসতে পারেন। তাই নিজের স্বার্থেই তাঁদেরকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চতুর্থ হেনরি। ১৪৫৪ থেকে ১৪৭৪ সাল পর্যন্ত কাস্তিলের রাজা ছিলেন তিনি। তখন পর্যন্ত স্পেন নামে কোনো একক রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান স্পেন তখন চারটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সবচেয়ে বড় অংশের নাম ছিল কাস্তিল, উত্তর-পূর্ব এলাকা আরাগান, দক্ষিণাংশ গ্রানাডা আর উত্তরাংশ নাভারে নামে পরিচিত ছিল। ১৪৬০ সালের মধ্যে ইসাবেলা হয়ে ওঠেন সমগ্র ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ধনী রাজকুমারী এবং কাস্তিল সাম্রাজ্যের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। কিন্তু এর কয়েক বছর পরই ঘটে যায় একটি দুঃখজনক ঘটনা। ১৪৬৮ সালের জুলাই মাসে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ইসাবেলার ছোট ভাই আলফনসোকে।কাস্তিলের অভিজাত সমাজ এই ষড়যন্ত্রের পেছনে চতুর্থ হেনরির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করে বসে এবং ইসাবেলাকে সিংহাসনে বসার অনুরোধ জানায়। কিন্তু তখনো ভাইয়ের মৃত্যুর শোক সামলে উঠতে পারেননি ইসাবেলা। তাই তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই সুযোগে অভিজাতদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে সিংহাসনে থেকে যান চতুর্থ হেনরি। হেনরির ইচ্ছা ছিল ইসাবেলাকে পর্তুগালের রাজার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ১৪৬৯ সালে ১৮ বছর বয়সে পালিয়ে গিয়ে ইসাবেলা আরাগনের যুবরাজ ফার্দিনান্দকে বিয়ে করে ফেলেন। এ ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে চতুর্থ হেনরি তাঁর নিজের মেয়ে হুয়ানাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। কিন্তু ১৪৭৪ সালে হেনরির মৃত্যুর পর ইসাবেলা সিংহাসনের উত্তরাধিকার দাবি করে বসেন। ফলে হুয়ানা এবং ইসাবেলার সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৪৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসাবেলা যুদ্ধে জয়ী হন। আর এদিকে ওই বছরই আরাগনের রাজা মারা যাওয়ায় সিংহাসনে বসেন যুবরাজ ফার্দিনান্দ। এরপর ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দ মিলিতভাবে স্পেনের বৃহদাংশ শাসন করতে শুরু করেন।তাঁদের ২৫ বছরের রাজত্বকালে তাঁরা স্পেনকে একটি একক রাজ্যে পরিণত করে শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে তোলার সমূহ প্রয়াস চালান। স্পেনের দক্ষিণাংশের মুসলিম শাসিত অঞ্চল গ্রানাডা জয় করার জন্য ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা ১৪৮১ সালের দিকে যুদ্ধ শুরু করেন এবং তাঁদের বিজয়ের মাধ্যমে ১৪৯২ সালের দিকে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।গ্রানাডা বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে কার্যত পুরো স্পেনীয় উপদ্বীপ, অর্থাৎ বর্তমান স্পেনের ভূ-সীমানা ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের একচ্ছত্র শাসনাধীনে চলে আসে। যে ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলা যুগপৎ স্মরণীয় ও সমালোচিত, তা হলো কুখ্যাত স্প্যানিশ ইনকুইজিশন। যেকোনো ধরনের ধর্মীয় মতান্তরকে রুদ্ধ ও পিষ্ট করার জন্য পুরোহিতদের সমবায়ে এই ট্রাইব্যুনালটি গড়ে তোলা হয়। এর শাস্তি ছিল যেমন নৃশংস, তেমনি এর বিচার পদ্ধতি ছিল অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কেউ অভিযুক্ত হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না। এমনকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তা জানার সুযোগ পর্যন্ত সেখানে ছিল না। অভিযোগ স্বীকার না করা পর্যন্ত অভিযুক্তদের ওপর চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন। এই ইনকুইজিশনে পোপের অনুমোদন থাকলেও এটা মূলত স্পেনের রাজাদের ধর্মীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল।ছোটবেলা থেকেই কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে প্রতিপালিত হওয়ায় একজন নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন ইসাবেলা। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর স্প্যানিশ জাতীয়তাবাদকে ভুলতে পারেননি। তিনি এবং ফার্দিনান্দ ক্যাথলিক চার্চকে পোপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে স্পেনের রাষ্ট্রক্ষমতারই অধীন রাখতে প্রয়াসী ছিলেন। আর এ কারণেই ষোড়শ শতকের প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন স্পেনে তেমন জোরদার হতে পারেনি। ১৫০৪ সালের ২৬ নভেম্বর মারা যান স্পেনের এই প্রভাবশালী রানী। 

No comments