শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৩-১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ)
শ্রীরামকৃষ্ণ
(১৮৩৩-১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ)
কামারপুকুর গ্রামের লাহাবাবুদের বাড়ির নাটমন্দিরে পাঠশালা। বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ছেলে গদাধরকে পাঁচ বছর বয়সে সেই পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিন্তু পড়াশোনায় খুব বেশি মন নেই গদাধরের। শুধু বাংলাটা পড়তে ভালো লাগে। অঙ্ক কষতে গেলেই মাথা গুলিয়ে যায়।
বামুনের ছেলে। ছোটবেলাতেই মুখে মুখে শিখেছে দেবদেবীর প্রণামমন্ত্র। সেগুলো কিন্তু সে বেশ গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারে। তার কিছুদিন পরেই রামায়ণ পড়তে পারে সুর করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার সুর এবং বলার ভঙ্গিও তার সুন্দর হয়েছে। তাই মধুযোগীর বাড়িতে তার রামায়ণ পড়া শুনতে ভিড় জমে যায়।
একদিন বিকেলবেলা সে রামায়ণ পাঠ করছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও শুনছে মনোযোগ দিয়ে। কাছেই আমগাছের ওপর বসে ছিল একটা হনুমান। সে লাফ দিয়ে ঠিক গদাধরের কাছে এসে পড়ল। তারপর পা জড়িয়ে ধরল গদাধরের। হইচই করে উঠল সবাই। কেউ বা ভয় পেয়ে উঠে চলে গেল। কিন্তু গদাধর একটুও নড়ল না। সে হনুমানের মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বুঝি শ্রীরামচন্দ্রের আশীর্বাদ পেয়েই খুশি হয়ে রামভক্ত হনুমান আবার লাফ দিয়ে গাছে উঠে গেল।
অদ্ভুত ছেলে গদাধর! সব সময়েই ভাবাবেশে মত্ত হয়ে থাকে। পথে পথে ঘুরে গান করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। লোকজন ছুটে এসে মাথায় ও মুখে জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।
কামারপুকুর থেকে দুই মাইল দূরে আনুড় গ্রাম। সেখানে বিরাট এক গাছের তলায় আছে বিশালাক্ষীর থান। গাঁয়ের মেয়েরা দল বেঁধে চলেছে সেই বিশালাক্ষী দেবীর পূজা দিতে। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে গদাধর সেখানে সেই দলে ঢুকে পড়ল। গাঁয়ের মেয়েরা ভাবল, যাক ভালোই হয়েছে। গদাইয়েরও গান গেয়ে খুব আনন্দ হয়। বাবার কাছ থেকে শেখা দেবতার ভজন কী সুন্দর গায়।
কিন্তু বিশালাক্ষী থানের কাছাকাছি যেতেই তার গান থেমে গেল। দুই চোখ বেয়ে পড়তে লাগল জলের ধারা। প্রসন্ন বলে মেয়েটি এগিয়ে এসে তাকে ধরতেই তার কোলে অবসন্ন হয়ে ঢলে পড়ল। গদাইয়ের জ্ঞান হতেই সে বলল, ওরে গদাইকে কিছু খেতে দে।
কিন্তু কী খেতে দেবে গদাইকে? কারোর সঙ্গে ভোগের সামগ্রী ছাড়া যে আর কিছু নেই। প্রসন্ন বলল, ভোগের জিনিসই আলাদা করে ওকে দে। ওকে খাওয়ালেই তোদের পুণ্যি হবে।
অনেকে পূজার জন্য আনা নৈবেদ্য থেকে কলা, দুধ ও বাতাসা গদাইয়ের মুখে তুলে দেয়।
বড় খামখেয়ালি ছেলে গদাধর। পড়াশোনা মোটেই করছে না। শুধু আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দল বেঁধে ছেলেদের সঙ্গে যাত্রা করে। কখনো সাজে কৃষ্ণ, কখনো শিব।
দেখতে দেখতে বড় হতে লাগল গদাধর। দাদা রামকুমার বলেন, গাঁয়ে ওর লেখাপড়া কিছু হবে না। আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব। লেখাপড়া শেখাব।
রামকুমার কলকাতায় ঝামাপুকুরে থাকেন। সেখানে একটা টোল খুলেছেন। সেখানেই ছোটভাইকে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু সে গাঁ ছেড়ে যেতে চায় না।
১৮৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই কামারপুকুর গ্রামে জন্ম হয়েছে গদাধরের। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে এখানকার পথ-ঘাট, পুকুর, মা-বাবা ও গাঁয়ের লোকদের। এসব ছেড়ে যেতে কি ভালো লাগে।
পৈতে হয়েছে। দাই-মা ধনী কামারনির আদর পেয়েছে। মা চন্দ্রমণির দিকে যেমন টান, ধনী কামারনির দিকেও টান তার কম নয়। বাবাকেও ভালোবাসে খুব। কিন্তু সাত বছর বয়সেই বাবাকে হারাতে হলো হঠাৎ। ছিলিমপুরে থাকেন বাবার ভাগনে রামচাঁদ। তার বাড়িতে দুর্গাপূজায় পুরোহিত হয়ে পূজা করতে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। সেখানেই ভাসানের দিন রাত্রিবেলায় মারা গেলেন। সেই খবর পেয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল গদাধর।
এবার গ্রাম ছাড়তেই হবে গদাধরকে। বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে যাওয়ার পরই রামকুমার তাকে কলকাতা যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বললেন। সে কথা শুনে গদাধরের মন খারাপ হয়ে গেল। ভাগনে হৃদয় তারই সমবয়সী। ক্ষুদিরামের শ্রাদ্ধের সময় এসেছে। তার সঙ্গে গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ায় গদাধর।
একদিন বেড়াতে বেড়াতে একটু দূরেই চলে গেল। গাঁ ছাড়িয়ে মাঠ, জমি। বেশ লোকের ভিড়। কয়েকজন লোক জমি ভাগাভাগি করছে। মাপছে দড়ি ফেলে। তাতেও হলো না। লেগে গেল তাদের মধ্যে ঝগড়া, তারপর হাতাহাতি। খুড়ো আর ভাইপোর মধ্যে বিবাদ। দুজনেই পণ্ডিত। অথচ কী মারামারি করল তারা। গদাধর ভাবল, ছিঃ, লেখাপড়া শিখেও মানুষ এমন হয়! এমন বিষয়-সম্পত্তিকে ধিক!
গদাধরের মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ।
রামকুমার গদাধরকে নিয়ে কলকাতায় এলেন। মধ্য কলকাতায় ঝামাপুকুরে অনেক রকম পুঁথি আছে টোলে। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখে গদাধর। রামকুমার বললেন, এসব পড়ে লাভ নেই। স্কুলে তোকে ভর্তি করিয়ে দেব। সেখানেই পড়বি।
গদাধর ঠোঁট উলটিয়ে বলল, আমি পড়বই না স্কুলে।
রামকুমার জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
গদাধর জবাব দিল, চালকলা বাঁধা বিদ্যা শিখতে চাই না।
তবে কী চাস?
আমি চাই এমন বিদ্যা শিখতে যাতে সত্যিকারের কোনো লাভ হয়। মানুষের জীবন ধন্য হয়।
রামকুমার ভাবলেন, ছোট ভাইটার মাথা নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গিয়েছে। লেখাপড়া যখন করবে না তখন দেবসেবাই করুক। তাই বললেন, ব্রাহ্মণের সন্তান, পূজার মন্ত্রতন্ত্র ভালো করে শিখে নে। ব্যাকরণ, শাস্ত্র এসব পড়াশোনা কর।
গদাধর তাতে কোনো আপত্তি করে না। পূজার মন্ত্রের বই নাড়াচাড়া করে। রামকুমার টোলে পড়ানো ছাড়া যজমানদের বাড়িতে পূজাও করেন। গদাধরও সঙ্গে যায়। যতক্ষণ দাদা পূজা করেন সবকিছু দেখে গদাধর পূজামন্ত্রও আয়ত্ত করে। ঘরে ফিরে এসে পূজার মন্ত্র ও নিয়মকানুন লেখা বইও দেখে নেয়। কয়েকদিনের মধ্যে তার অনেক কিছু শেখা হয়ে যায়।
ঝামাপুকুরের পিতাম্বর মিত্তির বাড়ির বিগ্রহের পুরোহিত ছিলেন রামকুমার। একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারলেন না। তিনি গদাধরকে বললেন, তুই একটু পুজোটা করে দিয়ে আসবি?
গদাধর বেশ খুশিমনেই গেল। পূজা করল। তার পূজা দেখে বাড়ির গিন্নিরা ও মেয়েরা কী খুশি। কী সুন্দর মন্ত্রপাঠ করে গদাধর। পূজা করতে করতে সে কখনো যেন তন্ময় হয়ে যায়। মেয়েরা বেশি করে চাল করা ও নৈবেদ্যর ডালি তাকে দিয়ে দেয়। গদাধর আপত্তি জানিয়ে বলে, এত দিচ্ছ কেন?
মেয়েরা ভক্তিতে গদগদ হয়ে প্রণাম করে তাদের নবীন পূজারিকে। এরপর থেকে মিত্রবাড়ির নিয়মিত পূজারি হয়ে গেল গদাধর।
গদাধরের কিন্তু ওসবের দিকে কোনো লোভ নেই। মাঝে মাঝে যজমানের বাড়ি থেকে পাওয়া সবকিছু পথের এক ভিখারিকে দিয়ে দেয়। এ জন্য দাদার ভর্ৎসনাও শুনতে হয় গদাধরকে। গদাধর বলে, আমাদের তো অনেক আছে, ওদের যে কিছুই নেই। মনে মনে রামকুমার ভাবেন, গরিবের ঘরে জন্ম হলেও রাজার মন নিয়ে গদাধর জন্মেছে।
বড় হয়ে উঠছেন গদাধর। দেখতে তাঁকে ভক্তিমান ব্রাহ্মণ বলেই মনে হয়। কিন্তু কেমন যেন উদাস উদাস ভাব।
রামকুমার খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। গদাধরের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এমন সময় এক সুযোগ এসে গেল তাঁদের সামনে।
কলকাতার জানবাজারের রানী রাসমণি মন্দির স্থাপন করলেন দক্ষিণেশ্বরে। সে অতি বিচিত্র কাহিনী। কাশীতে অন্নকূট উৎসব করার জন্য বিরাট বিরাট নৌকায় বহু খাদ্যসামগ্রী ও লোকজন নিয়ে জনপথে চলেছিলেন রানী রাসমণি। রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন। জগজ্জননী মূর্তিমতী হয়ে তাঁকে বললেন, ওরে তোর কাশী যাওয়ার দরকার নেই। গঙ্গদার তীরে এখানেই মন্দির তৈরি করে আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। আমাকে অন্নভোগ দে।
রাসমণির আর কাশী যাওয়া হলো না। গঙ্গার দক্ষিণেশ্বরে মন্দির নির্মাণ করলেন। খরচ হলো নয় লাখ টাকা। নবরত্নবিশিষ্ট কালীমন্দির, উত্তর ভাগে রাধাগোবিন্দ মন্দির, পশ্চিমে গঙ্গার তীরজুড়ে দ্বাদশ শিবের মন্দির। মূর্তিও তৈরি হলো। মূতি ছিল বাক্সের মধ্যে। দেখা গেল মূর্তি ঘামছে। রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন রানীমা। ভবতারিণী কালী বলছেন, আমাকে আর কত দিন এভাবে কষ্ট দিবি? এবার আমায় মুক্তি দে।
১২৬১ সালের ১২ জ্যৈষ্ঠ স্নানযাত্রার দিনে মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু মায়ের অন্নভোগ দেয়ার কী হবে? মার যে অন্নভোগ দেয়ার অধিকার তোমার নেই। কারণ তুমি যে জেলের মেয়ে।
দেবীকে ভোগ দেব, তাতেও জাতবিচার? রানীর হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠল। রানীর জামাতা মথুরামোহন সবকিছু দেখাশোনা করতেন। তিনি নানা দেশের পণ্ডিতদের কাছে বিধান নিতে ছুটলেন। কিন্তু সব পণ্ডিতেরই এক কথা। অচ্ছুৎ রামকুমারের কাছে। রামকুমার বিধান দিলেন মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি যদি রানী কোনো ব্রাহ্মণকে দান করেন তবেই অন্নভোগ দেয়া চলতে পারে।
রানী অকূলে যেন কূল পেলেন। তিনি ঠিক করলেন গুরুর নামে মন্দির দান করবেন। কিন্তু গুরুর বংশের কেউ পুরোহিত হয় এ তাঁর কাম্য নয়। কারণ তাঁরা সকলেই অশাস্ত্রজ্ঞ এবং আচার্যসর্বস্ব। অন্য সৎ ব্রাহ্মণও পাওয়া গেল না। অন্য কেউ মন্দিরের পূজা করতে রাজি হলেন না।
মন্দির প্রতিষ্ঠা-উৎসবের দিন রামকুমার এলেন গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে। বিরাট আয়োজন কালীবাড়িতে। যাত্রাগান, কালীকীর্তন, ভাবগত পাঠ। মহা ধুমধাম কাণ্ড। সকাল থেকে চলছে খাওয়া-দাওয়া। কে আহূত কে অনাহূত, কার কী জাত তার খোঁজ-খবরও করে না কেউ।
গদাধর কিন্তু কিছুই খেলেন না। বাজার থেকে মুড়ি কিনে খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলেন। রাত্রিবেলা রামকুমার গদাধরকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানকার ভোগের প্রসাদ তুই নিলিনে কেন?
গদাধর জবাব দিলেন, এমনি নিইনি।
রামকুমার অবাক হলেন। অথচ এই গদাধরই ছোটবেলায় ধনী কামারনির কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়েছে। শিয়র গ্রামের রাখালদের সঙ্গে বসে খেয়েছিল। খেয়েছিল ছুতোর বাড়ির বউয়ের হাতে খিচুড়ি রান্না। চিনিবাস শাঁখারীর হাতে মিষ্টি। আনুড়ে বিশালাক্ষী মায়ের থানে নানা জাতের মেয়ের দেয়া পূজার প্রসাদ খেয়েছিল। তখন তো জাতবিচার করেনি। আশ্চর্য!
কারণ জিজ্ঞেস করলে গদাধর জবাব দিলেন, ওরা দিয়েছিল অতি যত্নের বিদুরের খুদ। কিন্তু এ যে হেলায় ফেলায় দেয়া দুর্যোধনের রাজভোগ।
জবাব শুনে অবাক হয়ে গেলেন রামকুমার। বাহ, রামায়ণ মহাভারত পড়ে আর টোলের বই ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক কিছুই তো এ বয়সে গদাধর শিখে ফেলেছে।
রামকুমার বললেন, তা হলে কী করতে বলিস আমাকে? ঝামাপুকুরে ফিরে যাব? রানীমা যে আমাকে এখানে পুরোহিত করতে চান। সে কাজ তা হলে নেব না?
গদাধর বললেন, কথা যখন দিয়েছ তখন ছাড়বে কেন? আর তোমার টোলও তো প্রায় উঠেই গেছে। তুমি এখানেই থাক।
তুই কী করবি?
আমিও থাকব তোমার কাছে। এখানে খাব না।
এখানকার কিছু না খেতে চাস আমি পয়সা দেব, বাজার থেকে চাল ডাল কিনে রান্না করে খাস।
গদাধর তাতেই রাজি হলেন।
কিন কাটতে লাগল ভালোভাবেই। একদিন ভাগনে হৃদয় সেখানে এসে হাজিল হলো। গদাধরের প্রায় সমবয়সী। হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। বলল, বর্ধমানে গিয়েছিলেন চাকরির খোঁজে। হলো না। শুনলাম, তোমরা দুই মামাই আছ দক্ষিণেশ্বরে। তাই চলে এলাম।
রামকুমার বললেন, ‘বেশ, থাক এখানে। একটা কিছু হবেই। তুই থাকলে গদাধরের সুবিধা হবে।’
মথুরবাবু মাঝে মাঝে এসে মন্দিরের কাজ দেখাশোনা করেন। পরের দাসত্ব করতে তার ভালো লাগে না।
গদাধর মাটি দিয়ে শিব গড়ে পূজা করেন। নিজেই পূজা করে বাতাসা ভোগ দিয়ে হৃদয়কে প্রসাদ দেন। গদাইয়ের হাতে গড়া শিবমূর্তি একদিন মথুরবাবু দেখতে গেলেন। কী অপূর্ব মূর্তি। গদাধর তখন কাছে ছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন হৃদয়কে এ মূর্তি কে গড়েছে?
হৃদয় বলল, গদাই মামা।
আমাকে দিতে পার এ মূর্তি?
হ্যাঁ। নিয়ে যান। ছোট মামা এ রকম মূর্তি অনেক গড়তে পারে।
মথুরামোহন সেই মূর্তি নিয়ে গেলেন জানবাজারের বাড়িতে। রাসমণিকে দেখিয়ে বললেন, দেখুন মা, পুরুত ঠাকুরের ছোট ভাই গড়েছে।
রাসমণি বললেন, বাঃ বেশ তো। ওকে আমাদের মন্দিরের বিগ্রহের সাজনদার করলে বেশ হয়।
মথুরামোহন বললেন, আচ্ছা, আমি বলে দেখি পুরুত ঠাকুরকে।
পরদিন মথুরামোহন দক্ষিণেশ্বরে এসে রামকুমারকে ব্যাপারটা জানালেন। রামকুমার বললেন, গদাই যা খামখেয়ালি ছেলে। আমার কথা কি শুনবে? আপনি বললে যদি রাজি হয়।
মথুরামোহন তখন ডেকে পাঠালেন গদাধরকে। গদাধর ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মথুরাবাবুর সামনে। মথুরাবাবু বললেন, তুমি ঘুরে ঘুরে বেড়াও কেন? তোমার মনের মতো একটা কাজ দিলে করবে?
কী কাজ?
মা ভবতরিণীকে তুমি নিজের মতো করে সাজাবে।
ভয়ে কুঁকড়ে উঠলেন গদাধর। বললেন, একা সাহস হয় না সেজবাবু। ঘরে সব দামি দামি জিনিস। সঙ্গে হৃদয় থাকে তো পারি।
বেশ তো। সে তোমার সাগরেদ থাকবে। কাজ করবে দুজনে মিলে।
মনের মতো কাজ পেয়ে খুশিই হলেন গদাধর।
জন্মাষ্টমীর পরদিন সন্দোৎসব। রাধা-গোবিন্দের মন্দিরে বিশেষ পূজা ও ভোগ অনুষ্ঠান। সেই বিগ্রহের পূজারি ক্ষেত্রনাথ। দুপুরে পুজোর পর পাশের ঘরে শয়ন দিতে নিয়ে যাচ্ছেন রাধা-গোবিন্দকে। হঠাৎ পা পিছলে ক্ষেত্রনাথ পড়ে গেলেন। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল গোবিন্দের একটি পা।
মন্দিরে হইচই পড়ে গেল। হায়, একি অঘটন।
রানী রাসমণিকে খবর পাঠানো হলো। তিনি মধুরামোহনকে বললেন, পণ্ডিতদের কাছ থেকে বিধি নাও, কীভাবে ওই বিগ্রহের পূজা করা হবে?
মথুরামোহন অনেক পণ্ডিতের সঙ্গেই পরামর্শ করলেন। তাঁরা বললেন, ওই বিগ্রহকে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে। তার জায়গায় বসাতে হবে নতুন মূর্তি।
কিন্তু রানীর মন তাতে সায় দিল না। যে গোবিন্দকে এত দিন গৃহদেবতা রূপে পূজা করা হয়েছে, তাকে বিসর্জন দিতে হবে?
গদাধরের কানে সে কথা যেতেই তিনি বললেন, সে কি কথা। কোনো জামাইয়ের যদি ঠ্যাং ভেঙে যায়, তাতে কি ফেলে দিতে হবে, না চিকিৎসা করাতে হবে। গোবিন্দ গৃহদেবতা, নিতান্ত আপন। সেই আপনজনকে ফেলে দেব কেন? আমিই ঠাকুরের পা জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি।
একথা শুনে রাসমণির মনের চিন্তা দূর হয়ে গেল। তিনি বললেন, ছোট ভট্টাচার্য যা বলেছেন তাই ঠিক।
গদাধর মাটি দিয়ে সুন্দরভাবে জুড়ে দিলেন গোবিন্দের পা। বোঝাই গেল না যে পা ভেঙে গিয়েছিল। সেই মূর্তিই সিংহাসনে বসানো হলো।
Post a Comment