Header Ads

test

গৌতম বুদ্ধ (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩-৫৬৩)


গৌতম বুদ্ধ
(খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩-৫৬৩)

প্রাচীন ভারতে বর্তমান নেপালের অন্তর্গত হিমালয়ের পাদদেশে ছিল কোশল রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী কপিলাবস্তু। কোশলের অধিপতি ছিলেন শাক্যবংশের রাজা শুদ্ধোধন। শুদ্ধোধনের সুখের সংসারে একটি মাত্র অভাব ছিল। তাঁর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। বিবাহের দীর্ঘদিন পর গর্ভবতী হলেন জ্যেষ্ঠা রানী মায়াদেবী। সে কালের প্রচলিত রীতি অনুসারে সন্তান জন্মানোর সময় পিতৃগৃহে যাত্রা করলেন মায়াদেবী। পথে লুম্বিনী উদ্যান। সেখানে এসে পৌঁছতেই প্রসব বেদনা উঠল রানীর। যাত্রা স্থগিত রেখে বাগানেই আশ্রয় নিলেন সকলে। সেই উদ্যানেই জন্ম হলো বুদ্ধের। যিনি সমস্ত মানবের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তিনি রাজার পুত্র হয়েও কোনো রাজপ্রসাদে জন্মগ্রহণ করলেন না, মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নীল আকাশের নিচে আবির্ভূত হলেন।

পুত্র জন্মানোর কয়েক দিন পরেই মারা গেলেন মায়াদেবী। শিশুপুত্রের সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন খালা মহাপ্রজাপতি। শিশুপুত্রের নাম রাখা হলো সিদ্ধার্থ। রাজা শুদ্ধোধন জ্যোতিষীদের আদেশ দিলেন শিশুর ভাগ্য গণনা করতে। তাঁরা সিদ্ধার্থের ভাগ্য গণনা করে বললেন, এই শিশু একদিন পৃথিবীর রাজা হবেন। যে দিন এক জরাজীর্ণ বৃদ্ধ মানুষ, রোগগ্রস্ত মানুষ, মৃতদেহ এবং সন্ন্যাসীর দর্শন পাবে সেই দিনই সংসারের সকল মায়া পরিত্যাগ করে গৃহত্যাগ করবে। চিন্তিত হয়ে পড়লেন শুদ্ধোধন। মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন এই শিশুকে সুখ, বৈভব আর বিলাসিতার স্রোতে ভাসিয়ে দিন, তাহলে আর কোনো গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হবে না। স্বতন্ত্র প্রাসাদেই স্থান হলো রাজপুত্র সিদ্ধার্থের। যেখানে কোনো জরা ব্যাধি মৃত্যুর প্রবেশ করার অধিকার নেই। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলেন সিদ্ধার্থ। যৌবনে পা দিতেই রাজা শুদ্ধোধন তাঁর বিবাহের আয়োজন করলেন। সমভ্রান্ত বংশীয় সুন্দরী কিশোরী যশোধরার সাথে বিবাহ হলো সিদ্ধার্থের।

বিবাহের পর কিছু দিন আনন্দ উৎসবে মেতে রইলেন সিদ্ধার্থ। যথাসময়ে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হলো। তার নাম রাখা হলো রাহুল। সন্তানের জন্মের পর থেকেই পরিবর্তন শুরু হলো সিদ্ধার্থের। একদিন পথে বের হয়েছেন এমন সময় তাঁর চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ। অস্থিচর্মসার, মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। মুখে একটিও দাঁত নেই, গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিল। বৃদ্ধকে দেখামাত্রই রথ থামালেন সিদ্ধার্থ। তাঁর সমস্ত মন বিচলিত হয়ে পড়ল-মানুষের একি ভয়ঙ্কর রূপ? ভারাক্রান্ত মনে প্রাসাদে ফিরে গেলেন সিদ্ধার্থ। কয়েক দিন পর হঠাৎ সিদ্ধার্থের চোখে পড়ল একটি গাছের তলায় শুয়ে আছে একজন মানুষ। অসুস্থ রোগগ্রস্ত, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। বিমর্ষ হয়ে পড়লেন সিদ্ধার্থ। তাহলে তো যৌবনেও সুখ নেই। যেকোনো মুহূর্তে ব্যাধি এসে সব সুখ কেড়ে নেবে।

কিছুদিন পর সিদ্ধার্থের চোখে পড়ল রাজপথ দিয়ে চলেছে এক শবযাত্রা। জীবনে এই প্রথম মৃতদেহ দেখলেন-প্রিয়জনদের কান্নায় চারদিক মুখর হয়ে উঠেছে। বিস্মিত হলেন সিদ্ধার্থ-কিসের এই কান্না? সারথি চন্ন বলল, প্রত্যেক মানুষের জীবনের পরিণতি এই মৃত্যু। মৃত্যুই জীবনের শেষ তাই প্রিয়জনকে চারদিনের জন্য হারানোর বেদনায় সকলে কাঁদছে। আনমনা হয়ে গেলেন সিদ্ধার্থ। এক জিজ্ঞাসা জেগে উঠল তার মনের মধ্যে। মৃত্যুই যদি জীবনের অন্তিম পরিণতি হয় তবে এই জীবনের সার্থকতা কোথায়? রাজপ্রাসাদের সুখ ঐশ্চর্য বিলাস সব তুচ্ছ হয়ে গেল সিদ্ধার্থের কাছে। প্রতি মুহূর্তে মনে হলো এই জরা ব্যাধি মৃত্যুর হাত থেকে কে তাঁকে মুক্তির সন্ধান দেবে? অকস্মাৎ দেখা হলো এক সন্ন্যাসীর সাথে। সিদ্ধার্থ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন আপনি এই সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন? সন্ন্যাসী বললেন, আমি জেনেছি সংসারের সবকিছুই অনিত্য। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু যে কোনো মুহূর্তে জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই আমি যা কিছু অবিনশ্বর চিরন্তন তারই সন্ধানে বের হয়েছি। আমার কাছে সুখ-দুঃখ, জীবন-মৃত্যু সব এক হয়ে গেছে।

সিদ্ধার্থ সকলের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। দিবারাত্র চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গেলেন।  সকলের অগোচরে গভীর রাতে নিজের কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন সিদ্ধার্থ। পেছনে পড়ে রইল স্ত্রী যশোধরা, পুত্র রাহুল, পিতা শুদ্ধোধন, মহাপ্রজাপতি। অশ্বশালায় ঘুমিয়ে ছিল সারথি চন্ন। তাঁকে ডেকে তুললেন সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থকে রথে নিয়ে চললেন চন্ন। নগরের সীমানা পার হয়ে, জনপদ গ্রাম পার হয়ে, রাজ্যের সীমানায় এসে দাঁড়ালেন। এবার সারথি চন্নকে বিদায় দিতে হবে। নিজের সমস্ত অলংকার রাজবেশ খুলে উপহার দিলেন চন্নকে। তারপর বললেন, তুমি পিতাকে বলো আমি যদি কোনো দিন জরা ব্যাধি মৃত্যুকে জয় করতে পারি তবে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসব। আমি মানুষকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে আলোর পথ দেখাতে চাই। চলতে চলতে অবশেষে সিদ্ধার্থ এসে পৌঁছলেন রাজগৃহে। তখন রাজগৃহ ছিল কোথাও কোনো জনমানব নেই, চারদিক নির্জন, শুধু পাখির কূজন আর বয়ে চলা বাতাসের শব্দ। ভালো লেগে গেল সিদ্ধার্থের। তিনি স্থির করলেন এখানেই বিশ্রাম গ্রহণ করবেন। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল পাহাড়ের ছোট ছোট গুহায় ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন সব সাধু। একটি গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন সিদ্ধার্থ। সেই গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন আলাড়া নামে এক সাধু। সিদ্ধার্থ গুহার অদূরে বসলেন।

আলাড়ার ধ্যান ভঙ্গ হতেই সিদ্ধার্থ তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয়, গৃহত্যাগের কারণ বর্ণনা করে বললেন, আমি মুক্তির পথের সন্ধান করছি। আপনি আমাকে বলে দিন কোন পথ ধরে অগ্রসর হলে আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। সেখানেই রয়ে গেলেন সিদ্ধার্থ। একটি গুহায় তিনি বাসস্থান করে নিলেন। সমস্ত দিন ধ্যান বেদপাঠ শাস্ত্রচর্চার মধ্যে অতিবাহিত হতো। দিন কেটে যায়। গুরু আলাড়ার কাছে শিক্ষা পেয়ে অনেক কিছু জ্ঞানলাভ করেছেন সিদ্ধার্থ কিন্তু তাঁর অন্তরে যেন অতৃপ্তি রয়ে যায়। নতুন গুরুর সন্ধানে বের হরেন সিদ্ধার্থ। এবার এলেন উদ্দাক নামে এক সাধুর সান্নিধ্যে। দীক্ষা নিলেন তাঁর কাছে। সেই একই জীবনচর্চা শাস্ত্রপাঠ জন-যজ্ঞ-এতে বাইরের আড়ম্বর আছে কিন্তু  অন্তরের সপর্শ নেই। সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করতে পারলেন যে জ্ঞান, পরম সত্যের অন্বেষণ তিনি করছেন, কোনো সাধুই তাঁর সন্ধান জানেন না। হতাশায় ভেঙে পড়লেন। তিনি অনুভব করলেন তাঁর পথের সন্ধান অপর কেউ তাঁকে দিতে পারবে না। অন্ধকারের মধ্যে তাঁকেই খুঁজে বের করতে হবে আলোর দিশা। ঘুরতে ঘুরতে এসে উপস্থিত হলেন উরুবেলা নামে এক নগর প্রান্তে। যেখানে পাঁচজন সাধু বহুদিন তপস্যা করছিলেন। সিদ্ধার্থের আসার উদ্দেশ্য শুনে তারা বলল তুমি তপস্যা করব।

সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন করে আমি তপস্যা করব? দিন-রাত্রি তিনি একই আসনে বসে ধ্যান করে চলেন। এত আত্মনিগ্রহ করেও যে প্রজ্ঞা জ্ঞানের সন্ধান করছিলেন তার কোনো দিশা পেলেন না সিদ্ধার্থ। মনে হলো যাকে তিনি উপলব্ধি করতে চাইছেন, সে পরম সত্য যেন ধরা দিতে গিয়েও দূরে সরে যচ্ছে। সিদ্ধার্থ স্থির করলেন আর আত্মনিগ্রহের পথে তিনি অগ্রসর হবেন না। কাছেই এক গ্রামে ছিল একটি মেয়ে, নাম সুজাতা। ধর্মপ্রাণা ভক্তিমতী। প্রতি বছর সে মনের কামনা পূরণের আশায় বৃক্ষ দেবতার কাছে পূজা দিত। প্রতি বছর যে বৃক্ষের তলায় সুজাতা পূজা দিত, সিদ্ধার্থ স্নান সেরে অর্ধমৃত অবস্থায় সেই বৃক্ষের তলায় এসে বসেছিলেন। সুজাতা দাসী পুন্নাকে নিয়ে বৃক্ষতলায় এসে সিদ্ধার্থকে দেখে বিস্মিত হলেন। সুজাতা সিদ্ধার্থের সামনে নতজানু হয়ে তাঁকে পায়েস প্রদান করলেন। সিদ্ধার্থের মনে হলো এও যেন ঈশ্বরেরই অভিপ্রেত। তিনি পায়েস গ্রহণ করে খাওয়া মাত্র সমস্ত শরীরে এক শক্তি অনুভব করলেন। প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠল তাঁর দেহ-মন।

সিদ্ধার্থ এবার সেই গাছের নিচেই ধ্যানে বসলেন। দিন কেটে গেল সন্ধ্যা হলো। ধীরে ধীরে পার্থিব জগৎ মুছে গেল তাঁর সামনে থেকে। এক অনির্বচনীয় অনুভূতি প্রজ্ঞা জ্ঞান ধীরে ধীরে জেগে ওঠে তাঁর মধ্যে। তিনি অনুভব করলেন জন্ম-মৃত্যুর এক চিরন্তন আবর্তন। সমস্ত বিশ্বজুড়ে রয়েছে এক অসীম অনন্ত শূন্যতা। তার মাঝে তিনি একা জেগে রয়েছেন। তারই মধ্যে সহসা জেগে ওঠে লোভ, কামনা-বাসনা, প্রলোভন। যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে চালিত করেছে। তারা কি এত সহজে নিজেদের অধিকার ত্যাগ করতে চায়! ধীরে ধীরে পার্থিব চেতনার জগৎ থেকে তিনি উত্তরণ করলেন পরম প্রজ্ঞার জগতে। দেহধারণ অর্থাৎ জন্ম থেকে মুক্তির মধ্যেই মানুষ সকল পার্থিব জগতের দুঃখ-কষ্ট থেকে উদ্ধার পেতে পারে। এই পরম মুক্তিরই নাম নির্বাণ। এই পরম জ্ঞান উপলব্ধির মধ্য দিয়ে যুবরাজ সিদ্ধার্থ হয়ে উঠলেন মহাজ্ঞানী বুদ্ধ।

সেই সময় সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল দুজন বণিক। তাদের দৃষ্টি পড়ল বুদ্ধের দিকে। দেখা মাত্রই মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল তারা। তারা বুদ্ধের পায়ের কাছে বসে বলল, প্রভু, আপনি আমাদের সব পাপ তাপ দুঃখ দূর করে আপনার শিষ্য করে নিন। বুদ্ধ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর অন্তস্থিত উপলব্ধিকে কি মানুষ গ্রহণ করতে পারবে! দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করার পর মনে হলো তাঁর এই সাধনা তো মানুষের মঙ্গলের জন্য, তাদের মুক্তির জন্য। তিনি তো শুধু নিজের নির্বাণের জন্য এই তপস্যা করেননি। বুদ্ধ স্থির করলেন সর্ব প্রথম তিনি তার উপদেশ প্রদান করবেন সেই পাঁচ সন্ন্যাসীর কাছে যারা তাঁর গুরু। তাঁকে উপহাস করে অন্যত্র চলে গেছে। তিনি দুই বণিককে আশীর্বাদ করে তাদের বিদায় দিয়ে সেই নিরঞ্জনা নদীতীরস্থ গাছটিকে প্রণাম করে এগিয়ে চলছেন। যে বৃক্ষের তলায় তিনি বোধি লাভ করেছিলেন সেই বৃক্ষের নাম হলো বোধিবৃক্ষ। যুগ যুগ ধরে মানুষ যার বেদিমূলে শ্রদ্ধা নিবেদন করে চলেছে।

বুদ্ধ চলতে চলতে এসে পৌঁছালেন সেই পাঁচ সাধুর কাছে। তাঁরা সকলেই কঠোর সাধনায় নিমগ্ন হয়েছে। বুদ্ধকে দেখামাত্রই তাঁরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল। বুদ্ধ তাঁদের সামনে গিয়ে বললেন, তোমরা এই আত্মনিগ্রহের পথ ত্যাগ কর। এই কৃচ্ছ্রসাধনাও যেমন প্রজ্ঞা লাভের পথের প্রতিবন্ধক তেমনি ভোগসুখ বিলাসের মধ্যেও সত্যকে জানা যায় না। ধীরে ধীরে পাঁচজন সাধুর মন থেকে সব সংশয় দূর হয়ে গেল। তারা উপলব্ধি করল তথাগত বুদ্ধই তাদের জীবনে আলোর দিশারি হয়ে এসেছেন। বুদ্ধ তাদের একে একে ধর্মের উপদেশ দিতে লাগলেন। তাঁর উপদেশ শোনার পর পাঁচজন সাধু বলল, আপনি আমাদের দীক্ষা দিন, আজ থেকে আমরা আপনার শিষ্য হব। বুদ্ধ তাদের দীক্ষা দিয়ে শিষ্য হিসেবে বরণ করে নিলেন। দেখতে দেখতে অল্প দিনের মধ্যেই বুদ্ধের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

প্রাচীন ভারতের বৈদিক ধর্মে মূর্তিপূজা না থাকলেও ছিল যাগযজ্ঞ আচার-অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ি। ব্রাহ্মণরা ছিল সমাজের সবকিছুর চালক। বুদ্ধের ধর্মের মধ্যে ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা করুণা প্রেম। তাই মানুষ সহজেই তাঁর ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এত দিন পুরোহিত ব্রাহ্মণরা মানুষকে বলত একমাত্র তারাই পারে মানুষকে মুক্তি দিতে। বুদ্ধ বললেন অন্য কেউ তোমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। তোমাদের জীবনচর্চার মধ্যেই আছে তোমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ। মানুষ নিজেই যেমন তার দুঃখকে সৃষ্টি করে, তেমনি নিজের চেষ্টার মধ্য দিয়েই সব দুঃখ থেকে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারে। তুমি সৎ জীবন-যাপন কর, পবিত্র আচরণ কর। অন্তরকে শুদ্ধ কর, উদার কর। সেখানে যেন কোনো কলুষতা সপর্শ করতে না পারে।

দলে দলে মানুষ আসতে আরম্ভ করল তাঁর কাছে। তিনি তাদের কাছে বললেন, অষ্টমার্গের কথা।

    প্রথম হচ্ছে সত্য বোধ-অর্থাৎ মন থেকে সকল ভ্রান্তি দূর করতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে নিত্য ও অনিত্য বস্তুর মধ্যে প্রভেদ।
    দ্বিতীয় হচ্ছে সংকল্প-সংসারের পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। যা কিছু পরম জ্ঞান তাকে উপলব্ধি করার জন্য থাকবে গভীর আত্মসংযমের পথ ধরে এগিয়ে চলা।
    তৃতীয় সম্যক বা সত্য বাক্য। কোনো মানুষের সাথেই যেন মিথ্যা না বলা হয়। কাউকে গালিগালাজ বা খারাপ কথা বলা উচিত নয়। অন্য মানুষের সাথে যখন কথা বলবে, তা যেন হয় সত্য পবিত্র আর করুণাময় পূর্ণ।
    চতুর্থ-সৎ আচরণ। সকল মানুষেরই উচিত ভোগবিলাস ত্যাগ করে সৎ জীবন-যাপন করা। সমস্ত কাজের মধ্যেই যেন থাকে সংযম আর শৃঙ্খলা। এছাড়া অন্য মানুষের প্রতি আচরণে থাকবে দয়া ভালোবাসা।
    পঞ্চম-হলো সত্য জীবন বা সম্যক জীবিকা অর্থাৎ সৎভাবে অর্থ উপার্জন করতে হবে এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনে এমন পথ অবলম্বন করতে হবে যাতে রক্ষা পাবে পবিত্রতা ও সততা।
    ষষ্ঠ-সৎ চেষ্টা। মন থেকে সকল রকম অশুভ ও অসৎ চিন্তা দূর করতে হবে-যদি কেউ আগের পাঁচটি পথ অনুসরণ করে তবে তার কর্ম ও চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই সংযত হয়ে চলবে।
    সপ্তম-সম্যক ব্যায়াম অর্থাৎ সৎ চিন্তা। মানুষ এই সময় কেবল সৎ ও পবিত্র চিন্তা-ভাবনার দ্বারা মনকে পূর্ণ করে রাখবে।
    অষ্টম-এই স্তরে এসে মানুষ পরম শান্তি লাভ করবে। তার মন এক গভীর প্রশান্তির স্তরে উত্তীর্ণ হবে।

বুদ্ধ যে অষ্টমার্গের উপদেশ দিয়েছিলেন তা মূলত তাঁর সন্ন্যাসী আশ্রম বা সঙ্গ শিষ্যদের জন্য। কিন্তু তিনি তাঁর প্রখর বাস্তব চেতনা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সাধারণ গৃহী মানুষ কখনোই এই অষ্টমার্গের পথকে সম্পূর্ণ অনুসরণ করতে পারবে না। তিনি সমগ্র মানব সমাজের জন্য দশটি নীতি প্রচলন করলেন-
১. তুমি কোনো জীব হত্যা করবে না।
২. অপরের জিনিস চুরি করবে না।
৩. কোনো ব্যভিচার বা অনাচার করবে না।
৪. মিথ্যা কথা বলবে না, কাউকে প্রতারণা করবে না।
৫. কোনো মাদকদ্রব্য গ্রহণ করবে না।
৬. আহারে সংযমী হবে। দুপুরের পর আহার করবে না।
৭. নৃত্যগীত দেখবে না।
৮. সাজসজ্জা অলঙ্কার পরবে না।
৯. বিলাসবহুল শয্যায় শোবে না।
১০. কোনো সোনা বা রূপা গ্রহণ করবে না।

এই দশটি উপদেশের মধ্যে প্রথম পাঁচটি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। আর সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে দশটি উপদেশই পালনীয়। বুদ্ধের এই উপদেশ জনগণের মধ্যে প্রচার করার জন্য তার ৬০ জন বিশিষ্ট শিষ্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। 


No comments