হিমু - ৯ম পরিচ্ছেদ
‘হুঁ।’
‘ভিখিরিদের সঙ্গে আমার একদিন-দু’দিন শুরুকরিনি, তবু অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য পাচ্ছি। একটা তোকে বলি—আমাদের ধারণা, মাসের এক-দুই তারিখের দিকে ভিখিরিরা বেশি ভিক্ষা পায়। লোকজনের হাতে বেতনের টাকা থাকে।তারা ভিক্ষা বেশি দেয়। ব্যাপার মোটেই তা না। সবচে’বেশি ভিক্ষা পায় মাসের শেষ সপ্তাহে। ইন্টারেস্টিং না?’
‘হুঁ। ইন্টারেস্টিং।’
‘রিসার্চের অনেক কিছু আছে। যারা ভিক্ষা দিচ্ছে তাদের নিয়েও রিসার্চ হওয়া দরকার। এই দিকে কোনো কাজই হয়নি। ভিক্ষুকদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আছে, এটা জানিস?’
‘জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি।’
‘নাস্তিকতা যে ভিখিরিদের মধ্যে সবচে’ বেশি এটা জানিস?’
‘আঁচ করতে পারি।’
‘ফ্যামিলি স্ট্রাকচার ওদের ভেঙে পড়েছে। স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকে, আবার স্ত্রী অন্য কারো সঙ্গেও কিছুদিন থেকে স্বামীর কাছে ফিরে আসে। স্বামীর বেলাতেও এটা সত্যি—এরা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক সমাজ তৈরি করছে। সেই সমাজের আইনকানুন আলাদা। এরা যাযাবরদের মতো হয়ে যাচ্ছে। কোথাও একনাগাড়ে তিন রাতের বেশি থাকবে না। ঘুরে-ঘুরে বেড়াবে। তোর কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?
‘লাগছে।’
‘ভিখিরিদের রোজগার সম্পর্কে আগে যে সমীক্ষা করেছিলাম সেটা পুরোপুরি ভুল। ভিখিরিদের মধ্যে নতুন মা যারা, অর্থাৎ যাদের বাচ্চার বয়স এক মাস-দু’মাস, তারা খুব ভাল রোজগার করতে পারে। তবে এইসব ক্ষেত্রে নতুন মা’র শীররদুর্বল বলে বের হতে পারে না—বাচ্চাটা ভাড়া খাটে। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা দৈনিক ভাড়া। এত সব তথ্য পাচ্ছি যে তুই কল্পনাও করতে পারবি না। এইসব তথ্য নিতে—নিতেই এক জীবন কেটে যাবে।’
‘এর মানে কি এই যে—তুই তোর জীবন এই গর্তে কাটিয়ে দিবি? নীতুর কাছে ফিরে যাবি না?’
ইয়াদ হাই তুলতে তুলতে বলল, দেখি।
‘আমি আজ যাচ্ছি।’
‘কাল আসবি?’
‘বুঝতে পারছি না—আসাতেও পারি। তোর কিছু লাগবে? লাগলে বল, নিয়ে আসব।’
‘কিছুলাগবে না।’
‘টাকাপয়সা লাগবে?’
‘না। পকেটে রুমাল থাকলে রেখে যা। সর্দি হয়ে গেছে। রুমালের অভাবে সামান্য অসুবিধা হচ্ছে।’
ইয়াদের কাছ থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় নেমে দেখি গাড়ি নিয়ে ম্যানেজার অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, আপনি এখনো যাননি? চলে যান।
‘আপনাকেপৌঁছে দিয়ে যাই স্যার।’
‘আমি হেঁটে বাড়ি ফিরব। পৌঁছে দিতে হবে না।’
‘আপাকে কী বলব?’
আমি কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করব। যা বলার আমি তখন বলব।’
‘উনি খুব অস্থির হয়ে আছেন স্যার।’
‘বুঝতে পারছি।’
‘আগামী কাল সকালের দিকে আসতে পারেন?’
‘না।’
‘কবে নাগাদ আসবেন? ঠিক দিনটা বললে আমার জন্যে ভাল হয়। আপা জিজ্ঞেস করবেন, কিছু বলতে না পারলে রাগ করবেন।’
‘ম্যানেজার হয়ে জন্মেছেন—বসের রাগ তো সহ্য করতেই হবে। ভিখিরি হয়ে জন্মালে কারোর ধার ধারতে হত না। বেঁচে থাকচেন যাদের দয়ায় উপর তাদের সমীহ করতে হচ্ছে না, ইন্টারেস্টিং না?’
ম্যানেজার জবাব দিল না। দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইল। বেচারার জন্যে আমার মায়া লাগছে—কিন্তু কিছু করার নেই। নীতু সঙ্গে দেখা করতেযাবার সময় হয়নি। নীতুকে অপেক্ষা করতে হবে।
রূপার চিঠি এসেছে। কী অবহেলায় খামটা মেঝেতে পড়ে আছে। আরেকটু হলে চিঠির উপর পা দিয়ে দাঁড়াতোম। খাম খুলে
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম—এতবড় কাগজে একটি মাত্র লাইন, তুমি কেমন আছ? নাম সই করেনি, তারিখ দেয়নি। চিঠি কোথেকে লেখা তাও জানার উপায় নেই। শুধু একটি বাক্য—তুমি কেমন আছ? প্রশ্নবোধক চিহ্নটি শাদা কাগজে কী কোমল ভঙ্গিতে আঁকা হয়েছে। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হল রূপার আগের চিঠি পুরোটা পড়া হয়নি। কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে? কোনোদিনও জানা যাবে না, কারণ চিঠি হারিয়ে ফেলেছি। নীতুকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। চিঠিটা নীতু পড়েছে। নীতুর কাছে যেতে হবে। যেতে ভরসা পাচ্ছি না, কারণ ইয়াদের খোঁজ পাচ্ছি না। সে আগেরজায়গায় নেই। তুলসী মেয়েটি ছিল। সে কিছু জানে না কিংবা জানলেও কিছু বলছে না।
নীতুর ম্যানাজারও জানে না। নীতু যাদের ইয়াদের পেছনে লাগিয়ে রেখেছিল তাদের ফাঁকি দিয়ে ইয়াদ সটকে পড়েছে। যে-মানুষ ভোল পাল্টে ঢাকার ভিক্ষুকদের সঙ্গে মিশে গেছে তাকে খুঁজে বের করবে। নীতু যখন তার সামনে এসে দাঁড়াবে তখন ইয়াদেক মাথা নিচু করে তার সঙ্গেই যেতে হবে, কারণ নীতুর আছে ভালবাসারপ্রচণ্ড শক্তি।এই শক্তি আগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ঈশ্বরমানুষকে দেননি। এই ক্ষমতা তিনি শুধু তাঁর কাছেই রেখে দিয়েছেন।
ইয়াদ কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হল মোরশেদ। সেও উধাও হয়ে গেছে। মজনু মিয়ার ভাতের হোটেলে সে খেতে আসে না। পুরানো বাসায় যায় না। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা জানি না। তবে সে তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাবে, তাও মনে হয় না।
সে একমাত্র এষার কাছেই যেতেপারে। কেন জানি মনে হচ্ছে তার কাছেও যায়নি। বড় শহরেহঠাৎ হঠাৎ কিছু লোকজন হারিয়ে যায়—কেউ তাদের কোনো খোঁজ দিতে পারে না। মোরশেদও কি হারিয়ে গেছে? অদৃশ্য হয়ে গেছে? প্রকৃতি মানুষকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। অদৃশ্য হবার ক্ষমতা দেয়নি। তবে মানুষের সেই অক্ষমতা প্রকৃতি পুষিয়ে দেবার ব্যবস্থাও করেছে—কেউ অদৃশ্য হতে চাইলে প্রকৃতি সেই সুযোগ করে দেয়।
একদিন গেলাম এষাদের বাড়ি। এষা দরজা খুলে আনন্দিত গলায়, আরে আপনি।
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি। ঐ যে আপনি গেলেন আর খোঁজ নেই। দাদিমা রোজ একবার জিজ্ঞেস করে লোকটা এসেছে।’
‘উনি কি আছেন?’
‘না, নেই। আমার কি ধারণা জানেন? আমার ধারণা আপনি খোঁজখবর নিয়ে আসেন। যখন দাদীমা থাকে না, তখনি উপস্থিত হন। আসুন, ভেতরে আসুন।’
আজ এষাকে অনেক হাসিখুশি লাগছে। মনে হচ্ছে তার বয়সও কমে গেছে। উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরেছে। তবে আজো খালি পা।
ঐদিন আপনি দাদীমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। উনার অষুধপত্র লেগেছিল। আপনি কিনে দিলেন। দাদীমা ঐ টাকা আপনাকে দিতেচাচ্ছেন। সে জন্যেই তিনি আপনাকে এত খোঁজ করছেন। আমিদাদীমাকে বললাম, তুমি শুধু-শুধু ব্যস্ত হচ্ছ—টাকা দিলেও উনি নেবেন না।’
‘টাকা নেব না এই ধারণা আপনারকেন হল?’
‘আপনাকে দেখে, আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে। আমি মানুষকে দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারি।’
‘না, বুঝতে পারেন না। টাকা আমি নেব। সব মিলিয়ে একচল্লিশ টাকা খরচ হয়েছে। আজ টাকাটা নিতেই এসেছি।’
‘আপনি সত্যি বলছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘বসুন, টাকা নিয়ে আসছি।’
এষা টাকা নিয়ে এল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এষা বলল, আপনি বসুন। আমি আবার বসলাম। এষা বসল আমার সামনে।সহজ গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি সামনের সপ্তাহে দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছি। আমেরিকার নিউজার্সিতে আমার মেজো ভাই থাকেন। ইমিগ্রেন্ট। তিনি আমার জন্যে গ্রীন কার্ডের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তাঁর কাছে চলে যাব।
‘বাহ্,ভাল তো!’
‘ভাল-মন্দ জানি না। ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।’
‘ভাল হাবরই সম্ভাবনা। নতুন দেশে, সম্পূর্ণ নতুন করে জীবন শুরু করতেপারবেন। এখানে থাকলে হঠাৎ-হঠাৎ পুরানো স্মৃতি আপনাকে কষ্ট দেবে। হয়তো হঠা একদিন মোরশেদের সঙ্গে পথে দেখা হল। আপনি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না, তিনিও ভেবে পাচ্ছেন না। কিংবা ধরুন খিলগাঁয় আপনাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল, আরে, এই বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে জোছনা রাতে দু’জন বসে কত গল্প করেছি…’
এষা আমাকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এসব আমাকে কেন বলছেন?
‘এম্নি বলছি।’
‘শুনুন হিমু সাহেব! আপনি খুব সুক্ষ্ণাভাবে আমার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।’
‘চেষ্টা করতে হবে কেন ? আপনার ভেতর এম্নিতেই অপরাধবোধ আছে। দেশ ছেড়ে চলে যাবার পেছনেও এই অপরাধবোধ কাজ করছে।’
‘সেটা নিশ্চয়ই দুষণীয় নয়।’
‘দূষণীয়। মানুষকে পুরোপুরি ধ্বংস করারক্ষমতা রাখে এমন ক’টি জিনিসের একটি হল অপরাধবোধ। আপনি এই অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলুন।’
‘কীভাবে ঝেড়ে ফেলব?’
‘দেশ ছেড়ে যাবার আগে মোরশেদ সাহেবের সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করুন। কথা বলুন, গল্প করুন। তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা দেখুন। চাকরি খোঁজার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য ও করতে পারি। কিছু ক্ষমতাবান মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।’
‘হিমু সাহেব। আপনি নিতান্তই আজেবাজে কথা বলছেন। আমি এর কোনোটিই করব না। এগারো তারিখ বেলা তিনটায় আমার ফ্লাইট। আমি অসম্ভব ব্যস্ত। তা ছাড়া ইচ্ছাও নেই।’
‘টিকিট কাটা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, মেজো ভাই টিকিট পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট।’
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, এষা, আপনি কিন্তু যেতে পারবেন না। আপনাকে থাকতেই হবে এই দেশেই।
‘তার মানে!’
‘মানে আমি জানিনা। আমি মাঝে-মাঝে চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। আমি স্পষ্ট দেখছি আপনি মোরশেদ সাহেবের হাত ধরে একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন?’
‘ভয় দেখাচ্ছি না। কি ঘটবে তা আগেভাগে বলে দিচ্ছি।’
‘প্লীজ, আপনি এখন যান। আপনার সঙ্গে আমার কথা বলাই ভুল হয়েছে। শুনুন হিমু সাহেব, এগারো তারিখে বেলা তিনটায় আমার ফ্লাইট—আপনার কোনো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর। প্লীজ এখন যান। আর কখনোএখানো এসে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’
আমাকে দু’টা টেলিফোন করতে হবে। রিকশা নিয়ে তরঙ্গিণী স্টোরে উপস্থিত হলাম। নতুন ছেলেটা কঠিন চোখে তাকাচ্ছে। আমি বললাম,বল পয়েন্ট কিনতে এসেছি। এই নিন দশ টাকা। ছেলেটার কঠিন চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল। সে আমাকে বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না বলেই ভয় পাচ্ছে।
‘কয়েকদিন আগে এক ম্যানেজার সাহেবকে কলম কিনতে পাঠিয়েছিলাম। এসেছিল?’
ছেলেটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার চোখে ভয় আরো গাঢ় হচ্ছে।
‘সেই কলমেও লেখা হচ্ছে না বলেই আরেকটা কেনার জন্যে আসা।’
‘ভাইজান, আপনার পরিচয় কি?’
‘আমারকোনো পরিচয় নেই। আমি কেউ না। আমি হলাম নোবডি। টেলিফোন ঠিক আছে/’
‘জ্বি আছে।’
‘দু’টা টেলিফোন করব।’
প্রথম টেলিফোন বাদলকে। বাদল চমকে উঠে চিৎকার করল—কে, হিমুদা না?
‘হুঁ।’
‘কোথেকে টেলিফোন করছ?’
‘কোথেকে আবার? জেলখানা থেকে।’
‘জেলখানা থেকে টেলিফোন করতে দেয়?’
‘দেয় না, তবে আমাকে দিয়েছে। জেলার সাহেব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
‘তা তো দেবেনেই।তুমি চাইলে কে “না” বলবে। তোমার কতদিনের জেল হয়েছে?’
‘ছ’মাস।’
‘সে কী। বাবা যে বলল, এক বছর।’
‘এক বছরেরই হয়েছিল। ভালব্যবহারের জন্যে মাফ পেয়েছি।’
‘তা হলে তোমার সঙ্গে আর মাত্র তিন মাস পর দেখা হবে।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার দারুণ লাগছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’
‘তুই আমার একটা কাজ করে দে বাদল। একজন লোককে খুঁজে বের করে দে।তাঁর নাম মোরশেদ।’
‘কোথায় খুঁজব?’
‘কোথায় যে সে আছে বলা মুশকিল। তবে আমার মনে হয় ১৩২ নম্বর খিলগাঁয় একতলা একটা বাড়ির সামনে সে গভীর রাতে একবার-না-একবার আসে। ঐ বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায়টা সে একটা আমগাছ দেখতে পায়। আসলে কোনো গাছ নেই, কিন্তু লোকটা দেখে।গাছটা দেখার জন্যেই সে প্রতিরাতে একবার সেখানে যাবে। আমার তাই ধারণা।’
‘বল কী!’
‘ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। জেল থেকে বের হয়ে তোকে সব গুছিয়ে বলব। এখন তোর কাজ হচ্ছে ঐ লোকটাকে বের করা । এবং তাঁকে বলা সে যেন অবশ্যি ১১ তারিখ বেলা তিনটার আগেই এয়ারপোর্টে বসেথাকে।’
‘কেন হিমুদা?’
‘একজন মহিলা ঐ সময় দেশ ছেড়ে যাবেন। লোকটার সঙ্গে মহিলার দেখা হওয়া উচিত। বলতে পারিব না?’
‘তোকে যেতে হবে না। তুই শুধু খবরটাদে।’
‘আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। মোরশেদ সাহেবকে আমি নিজেও খুঁজে বের করতে পারতাম, কিন্তু আমার অন্য কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে ইয়াদের সন্ধানে। নীতুর সঙ্গেও দেখা করতে হবে।
ইয়াদের বাড়ি সব সময় আলোয় ঝলমল করে। সন্ধ্যার পর থেকেই এরা বোধহয় সব ক’টা বাতি জ্বালিয়ে রাখে। আজ ওদের বাড়ি অন্ধকার। গেট থেকে গাড়ি-বারান্দা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের বাতিগুলো পর্যন্ত নেভানো। শুধু বারান্দায়বাতি জ্বলছে। আমি গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ নেই নাকি?
‘আপা আছেন।’
‘কুকুর দু’টা কোথায়—টুটি-ফুটি?’
‘ওরা বান্ধা আছে। ভয় নাই, যান।’
ভয় নেই বললেই ভয় বেশি লাগে। আমি ভয়ে-ভয়ে এগুচ্ছি। বারান্দায় বেতের চেয়ারে নীতুকে বসে থাকতে দেখলাম। আজ তার গায়ে শাদা রঙের শাড়ি। শাদা শাড়িতে নীল ফুলের সুতারকাজ। গায়ের চাদরটাও শাদা। শাদা রঙ মেয়েদের এত মানায়আজ প্রথম জানলাম। নীতু আমাকে দেখে উঠে এল। সহজ গলায়বলল, আসুন।
‘ভাল আছেন?’
‘হ্যাঁ, ভাল। এখানে বসবেন, না ভেতরে যাবেন?’
‘বারান্দাই ভাল।’
‘হ্যাঁ, বারান্দাই ভাল। আপনি কি লক্ষ করেছেন বেশির ভাগ সময় আমি বারান্দায় বসে থাকি?’
‘আমি লক্ষ করেছি।’
‘আপনার তাড়া নেই তো? আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে; আমি চা দিতে বলি। টুটি-ফুটিকে খাবার দিয়ে আসি। আমি খাবারনা দিলে ওরা কিছু খায় না।’
নীতু উঠে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভেবেছিলাম নীতুকে খুব আপসেটদেখব। সে রকম মনে হচ্ছে না। আপসেট যদি হয়েও থাকে নিজেকে সামলে নিয়েছে। আমি লক্ষ করেছি ছোটখাট ব্যাপারে যারা অস্থির হয়, বড় ব্যাপারগুলিতে তারা মোটামুটি ঠিকথাকে।
ঘরে তৈরি সমুচা এবং পটভর্তি চা। ট্রে নীতুনিয়ে এসেছে। এই কাজ সে কখনো করে না। খাবার আনার অন্য লোক আছে।
‘সমুচাগুলি এইমাত্র ভাজা হয়েছে, খান। ভাল লাগবে। সঙ্গে টক দেব?’
‘না। টুটি-ফুটিবে খাবার দেয়া দেয়া হয়েছে?’
‘দেয়া হয়েছে।’
‘ওরাও কি সমুচা খাচ্ছে?’
‘না, ওরা সেদ্ধ মাংস খাচ্ছে। হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করা মাংস। দিনে ওরা একবারই খায়।’
আমি সমুচা খেতে-খেতে বললাম, বিলেতি কুকুর একবার খায়, কিন্তু দেশীগুলি সারাক্ষণ খায়—কিছু পেলেই খেয়ে ফেলে।
‘ট্রেনিং দেয়া হয় না বলে সারাদিন খায়। ট্রেনিং দিলে ওরা একবেলা খেত। চা ঢেলে দেব?’
‘দিন।’
নীতু চা ঢেলে কাপ এগিয়ে দিল। আমি লক্ষ করলাম,শাদা শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নীতু কানে মুক্তার দুল পরেছে।
‘মিষ্টি হয়েছে?’
‘হয়েছে।’
নীতু চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বড় নিঃশ্বাস নিল। মনে হচ্ছে সে এখন কঠিন কিছু কিথা বলবে।
‘আপনি গিয়েছিলেন ইয়াদের কাছে?’
‘জ্বি।’
‘তাকে বলেছিলেন পাগলামি বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসতে?’
‘না।’
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। আপনি তাকে দেখে খুব মজা পেয়েছেন। একজনকে শুধু কথায় ভুলিয়ে ভিখিরিদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেয়া তো সহজ কাজ না। কঠিন কাজ। সবাই পারে না। আপনি পারেন।’
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, আমি ওকে কিছু বলিনি, কারণ বলার প্রয়োজন দেখিনি।
কেন প্রয়োজন দেখেননি?’
ও ফিরে আসবে। ওর প্রতি আপনার ভালবাসা প্রবল, সেই ভালবাসা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই।’
‘বড়-বড় কথা বলে আমাকে ভোলাতে চাচ্ছেন?’
‘না। যা সত্যি তাই বললাম।’
‘যা সত্যি তা আপনি কাউকে বলনে না, কারণ সত্যটা কি তা আপনি নিজেও জানেন না। আপনি বিভ্রমতৈরি করতে পারেন বলেই বিভ্রমের কথা বলেন। আমি খুব বিনীতভাবে আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আশা করেছিলাম আপন আসবেন। আসেননি। ইয়াদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন—তাও আমার কারণে যাননি। ইয়াদকে আপনি কানে মন্ত্র দিয়েছেন—তাকে বলেছেন যে দু’জন লোক তার পেছনে লাগানো আছে। যে জন্যে সে ভোররাতে সবার চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমি কি ঠিক বলছি না? চুপ করে থাকবেন না। উত্তর দিন।’
আমি বললাম , একটা সিগারেট কি খেতে পারি?
নীতু নরম গলায় বলল, অবশ্যই খেতে পারেন। আপনার বন্ধু গাঁজা খেয়ে মাঠে পড়ে ছিল, আপনি সিগারেট খাবেন না কেন?তবে ভাববেন না আপনাকে আমি সহজে ছেড়ে দেব। আপনাকে আমি শাস্তি দেব।
‘কি শাস্তি?’
‘আপনি তো ভবিষ্যৎ বলে বেড়ান। কাজেইআপনি নিজেই অনুমান করুন। দেখি আপনার অনুমান ঠিক হয় কি না।’
‘অনুমান করতে পারছি না।’
‘চা খাবেন আরেক কাপ? পটে চা আছে।’
‘না, আর খাব না। আমি এখন উঠব।আর আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না। ইয়াদ চলে আসবে।’
‘সান্ত্বনার জন্যে ধন্যবাদ।’
নীতু হাসল। কিন্তু তার চোখ অসুস্থ মানুষের চোখের মতো ঝকঝক করছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। নীতু বলল,আপনাকে কি শাস্তি দেবতা না বলেই চলে যাচ্ছেন যে। অনুমান করতে পারছেন না?
‘না।’
‘একটু চেষ্টা করুন। চেষ্টা করলেই পারবেন।’
‘পারছি না।’
‘আচ্ছা যান।’
নীতু উঠে দাঁড়াল। আমি গেটের দিকে এগুচ্ছি—এবং ভয় পাচ্ছি।অকারণ তীব্র ভয়।মনে হচ্ছে শীরর ভারী হয়ে এসেছে। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছি না। গেটের প্রায় কাছাকাছি চলে যাবার পর বুঝতে পারলাম নীতু কি শাস্তি দিতে যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা করল চেঁচিয়ে বলি—‘না নীতু , না।’
তার সময় পাওয়া গেল না—টুটি-ফুটি উল্কার মতো ছুটে এল। মাটিতে পড়ে যাবার আগে এক ঝলক দেখলাম বারান্দায় আঙুল দিয়ে উঁচিয়ে নীতু দাঁড়িয়ে আছে। ধবধবে শাদা পোশাকে তাকে দেখাচ্ছে দেবী প্রতিমার মতো। নীতু হিসহিস করে বলল, Kill him. Kill him.
আমি বাস করছি অন্ধকারে এবং আলোয়। চেতন এবং অবচেতন জগতের মাঝামাঝি। Twilight zon. আমার চারপাশের জগৎ অস্পষ্ট। আমি কি বেঁচে আছি? আমাকে ঘিরে অনেক লোকের ভিড় । এটা কি কোনো হাসপাতাল? আমার কোনো ক্ষুধাবোধ নেই, কিন্তু প্রবল তৃষ্ণা । পানি পানি বলে চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে। চিৎকার করতে পারছি না। স্বপ্ন ও সত্য একাকার হয়ে গেছে। বাস্তব এবং কল্পনা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগুচ্ছে। আমি এদের আলাদা করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না।
মোটা গম্ভীর স্বরে একজন কেউ বলছেন,
‘হিমু সাহেব! হিমু সাহেব। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? জবাব দেবার দরকার নেই—জবাব দেবার চেষ্টা করবেন না। শুধু আঙুল নড়ানোর চেষ্টা করুন। আমি আপনার ডাক্তার। আপনি যদি আমার কথা শুনতে পান তাহলে পায়ের আঙুল নড়ানোর চেষ্টা করুন।’
আমি প্রাণপ্রণে পায়ের আঙুল নাড়াতে চেষ্টা করি।পারি কি পারি না বুঝতে পারি না। মোটা গলার ডাক্তার সাহেবের কথাও শুনতে পাই না। আশেপাশে সব শব্দ অস্পষ্ট হয়ে আসে—তখন গভীর কোনো নৈঃশব্দ থেকে আমার বাবার গলা শুনতে পাই—
‘খোকা! খোকা! আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? শুনতে পেলে আঙুল-ফাঙুল নাড়াতে হবে না। মনে-মনে বল শুনতে পাচ্ছি। তা হলেই আমি বুঝব।শুনতে পাচ্ছিস খোকা?’
‘পাচ্ছি। তুমি আমাকে খোকা ডাকছ কেন? তুমিই তো নাম দিলে হিমালয়।’
‘তোর মা খোকা ডাকত—এই জন্যে ডাকছি। শোন্ খোকা, তোর অবস্থা তো কাহিল—টুটি-ফুটি তোর পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি অবশ্যি খুব খুশি।’
‘তুমি খুশি?’
‘খুব খুশি। মহাপুরুষ হবার একটা ট্রেনিং বাকি ছিল—তীব্র শারীরিক যন্ত্রণার ট্রেনিং। সেটি হচ্ছে।’
‘আমি কি মারা যাচ্ছি?’
‘বলা মুশকিল। ফিফটি-ফিফটি চান্স। এটাও ভাল হল—ফিফটি-ফিফটি চান্সে দীর্ঘদিন থাকার দরকার আছে। এ একঅসাধারণ অভিজ্ঞতা।’
‘বাবা তুমি কি সত্যি আমার সঙ্গে কথা বলছ, না এসব আমার মনের কল্পনা?’
এটাও বলা মুশকিল, ফিফটি-ফিফটি চান্স। শতকরা পঞ্চাচ ভাগ সম্ভবনা, পুরোটি তোর অসুস্থ থাকার কল্পনা। আবার পঞ্চাশ ভাগসম্ভবনা আমি কথা বলছি তো সঙ্গে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না, খোকা। ওরা তোকে মর্ফিয়া দিচ্ছে। তুই এখন ঘুমিয়ে পড়বি।’
‘আজ কী বার বাবা? কত তারিখ?’
‘জানিনা। তোরও জানার দরকার নেই। আমি এবং তুই আমরা দু’জনইএখন বাস করছি সময়হীন জগতে। এই জগতটা অদ্ভুত খোকা। ভারি অদ্ভুত। এই জগতে সময় বলে কিছু নেই। আলো নেই, অন্ধকার নেই…কিছুই নেই…’
‘আমার তারিখ জানার খুব দরকার। এগারো তারিখ এষা চলে যাবে। মোরশেদ সাহেবের এয়ারপোর্টে যাবার কথা। উনি কি গেছেন? এষা কি তাঁর সঙ্গে ফিরে এসেছে?’
‘তুই কি চাস সে ফিরে আসুক?’
‘চাই।’
‘তা হলে ফিরে এসেছে। সময়হীন জগতের মজা হচ্ছে, এই জগতের বাসিন্দারা যা চায়—তাই হয়। সমস্যা হচ্ছে এই জগতেরকেউ কিছু চায় না।’
‘হিমু সাহেব। হিমু সাহেব। আমিআপনার ডাক্তার। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? শুনতে পেলে পায়েল আঙুল নাড়ান। গুড, ভেরি গুড। দেখি, এবার পারবেন। ভেঙে পড়লে চলবে না—আপনাকে মনে জোর রাখতে হবে। সাহস রাখতে হবে।’
একসময় আমার জ্ঞান ফেরে। ডাক্তার চোখের বাঁধন খুলে দেন। আমি অবাক হয়ে চারপাশের অসহ্য সুন্দর পৃথিবীকে দেখি। ফিনাইলের গন্ধভরা হাসপাতালের ঘরটাকে ইভপুরীর মতো লাগে। মায়াময় একটি মুখ এগিয়ে আসে আমার দিকে
‘ছোটমামা, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি মোরশেদ। চিনতে পারছেন?’
‘পারছি। এষা কোথায়?’
‘ও বারান্দায় আছে। ভেতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। ওকে কি ডাকব?’
‘না, ডাকার দরকার নেই।’
‘আপনি কথা বলবেন না, ছোটমামা। আপনার কথা বলা নিষেধ।’
আমি কথা বলিনা। চোখ বন্ধ করে ফেলি—আবারো তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। ঘুমের ভেতরই একটা বিশাল আমগাছ দেখতে পাই। সেই গাছের পাতায় ফোঁটা-ফোঁটা জোছনা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। হাত ধরাধরি করে দু’জন হাঁটছে গাছের নিচে। মানব ও মানবী। কারা এরা? কি ওদের পরিচয়? দু’জনকেই খুব পরিচিত মনে হয়। অনেক দুর থেকে চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসে। আমি চমকে উঠে বলি, কে আপনি? কে?
ভারী গম্ভীর গলায় উত্তর আসে। আমি কেউ না, I am nobody!
(সমাপ্ত)
Post a Comment