Header Ads

test

হিমু - ৮ম পরিচ্ছেদ


টেলিফোন করার জায়গা পাচ্ছি না। গ্রীন ফার্মেসি বন্ধ। কম্পউটারের নতুন একটা সার্ভিস সেন্টার হয়েছে। ওদেরটেলিফোন আছে—গেলেই টেলিফোন করতে দেয়। সার্ভিস সেন্টারটিও বন্ধ। এসছি তরঙ্গিণী স্টোরে। নতুন ছেলেটা আমাকে দেখেই বলল, টেলিফোন নষ্ট। মিথ্যা বলছে বোঝাই যাচ্ছে। বলার সময় মুখের চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। সে মনে হয় আগেই থেকে ঠিক করে রেখেছিল—আমাকে দেখলেই বলবে,“টেলিফোন নষ্ট।”
আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, গোটা দশেক টাকা দিলে কি ঠিক হবে?
‘বললাম তো নষ্ট।’
‘আপনার চাকরি কতদিন হয়েছে?’
‘তা দিয়ে আপনের কী প্রয়োজন?’
‘কোনো প্রয়োজন নেই, এম্নি জিজ্ঞেস করছি। মুহিব এসেছিল এর মধ্যে?’
‘না।’
‘ওর ঠিকানা জানেন?’
‘না।’
‘আপনার ঠিকানা কি?’
‘আমার ঠিকানা ‍দিয়ে কি করবেন?’
ছেলাটা কঠিন গলার স্বর বের করছে। একে বিরক্ত করতে ভাল লাগছে। কি করে আরো রাগিয়ে দেয়া যায় তাই ভাবছি।
‘আপনাদের এই দোকান খোলে কখন?’
‘খামাখা প্যাচাল পাড়তেছেন ক্যান। সওদা করার থাকলে সওদা করেন, নয়তো যান গিয়া।’
‘আপনার ঠিকানাটা তো এখনও বলেননি?’
‘আরে দুত্তেরি।’
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, বল পয়েন্ট কলম আছে? দেখান দেখি।
সে একটা কলম সামনে রাখল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কলম দিয়ে খোঁচা মেরেসে যদি আমার চোখ গেলে দিতে পারত তাহলে খুশি হত।
‘দাম কত?’
‘দশ টাকা।’
‘বাংলাদেশি বল পয়েন্ট না?’
‘হুঁ।’
‘এগুলি তিন টাকা করে বাইরে বিক্রি হয়। আপনার এখানে দশ টাকা কেন?’
‘আপনে বাইরে থাইক্যাকিনেন।’
‘আমি আপনার এখান থেকে কিনতে চাচ্ছি। তিনটাকার জিনিস বেশি হলে চার টাকা হবে। তার চেয়েও বেশিহলে হবে পাঁচ। দশ টাকা কেন?’
‘দাম বেশি ঠেকলে নিবেন না।’
‘মানিব্যাগ খুলে আমি আমার শেষ সম্বল দশ টাকার নোটটা দিয়ে তিন টাকা দামের বল পয়েন্ট কিনে বেরহয়ে এলাম। টাকার সন্ধানে যেতে হবে। মাসের প্রথম তারিখে ফুপা আমাকে চার’শ টাকা দেন। শর্ত একটাই—আমি কখনোতাঁর বাসায় যেতে পারব না। তাঁর ছেলে বাদল যেন কখনো আমার দেখা না পায়। ফুপার ধারণা, আমার প্রভাবে বাদলেরসর্বনাশ হচ্ছে। বাদলকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় আমার কাছ থেকে দুরে রাখা। দু’মাস ফুপার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়নি।
ফুপার অফিসঘরে শীতকালেও এয়ার কুলার চলে। এয়ার কুলারের বিজবিজ আওয়াজ না হলে বোধহয় তাঁর মেজাজ আসে না।
‘কেমন আছেন ফুপা?’
ফুপা ফাইল থেকে মুখনা তুলেই বললেন, ভেতরে আস। অনেক দিন দেখা হয় না। তোমাকে তুই করে বলতাম, না তুমি করে বলতাম ভুলে গেছি। ভাল আছ?
‘জ্বি।’
‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি জেলে আছ। তোমার মতো লোক দীর্ঘদিন বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারে না। একসময়-না একসময় তাদের জেলে ঢুকতে হয়। এর মধ্যে পুলিশ ধরেনি তোমাকে?’
‘না’
‘আমি অবশ্যি বাদলকে বলেছি—তুমি জেলে আছ। তোমার এক বছরের সাজাহয়েছে। না বললে তোমার খোঁজ বের করার জন্যে অস্থির হয়ে পড়ত।’
‘আমি কি বসব ফুপা।’
ফুপা বিস্মিত হয়েবললেন, অনুমতি নিচ্ছ কেন? বস।
‘আপনার অফিসে ঢুকলেই নিজেকে অফিসের একজন কর্মচারী বলে মনে হয়।
আপনাকে মনে হয় বড় সাহেব। সামনে বসতে ভয় লাগে।’
ফুপা খুশি হলেন। ফাইল সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
‘তোমার টাকা আলাদা করে রেখেছি।’
‘থ্যাংকস ফুপা।’
‘নাও, খাম দু’টা রাখ। চার’শ চার’শ করে আটশ’ আছে।’
খাম পকেটে ভরলাম। ফুপা আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে আমার অফিসে কাজ করতে পার। এন্ট্রি লেভেল অফিসারের একটা পোস্ট খালি হয়েছে। আমরা অ্যাডভাটাইজ করব না। অ্যাডভাটাইজ করলে সামাল দেয়া যাবে না। তুমি চাইলে আজই তোমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া যেতে পারে।
‘বেতন কত?’
‘বেসিক তিন হাজার প্লাস ফর্টি পারসেন্ট হাউস রেন্ট। টু হানড্রেড কনভেন্স। থ্রী হানড্রেড মেডিকেল –হিসেব কর। কত হল?’
‘জটিল হিসাবে আমাকে দিয়ে হবে না ফুপা। তবে আমি খুব ভাল একজন লোক দিতেপারি। ভেরি অনেস্ট।’
‘তোমার কাছে তো আমি লোক চাইনি।’
‘তা চাননি। তবু হাত যখন আছে তখন বললাম। আমারজানামতে তাঁর মতো মানুষ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই। এর উপর আমি আট শ’ টাকা বাজি রাখতে পারি। এই টাকাটাই আমার সম্বল। আপনি যদি এমন কাউকে পান যে ঐ লোকটার মতো, তাহলে আমি সঙ্গে-সঙ্গে আপনাকে আট শ’ দিয়ে দেব।’
ফুপা চুরুট ধরাতে ধরাতে বললেন, কি আছে লোকটার যা অন্য কারোর নেই?
‘সে তার বাড়ির সামনে একটা আমগাছ দেখতে পার, যদিও সেখানে কোনো গাছ নেই। কোনোদিন ছিলও না। সে পরিষ্কার আমগাছ দেখে, গাছে পাখি বসে থাকতে দেখে। পাখির কিচিমিচির শুনতে পায়।’
ফুপা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি এই বদ্ধ উন্মাদকে আমার এখানে চাকরি দিতে চাচ্ছ?
‘জ্বি।’
‘কেন বল তো?’
‘ভদ্রলোকেরচাকরি খুব দরকার। উনি অসুস্থ। এপিলেপ্সি আছে। আগে ভাল চাকরি করতেন। এখন চাকরি নেই। যদি চাকরি হয় মানসিকশক্তি পাবেন। এতে শরীর সুস্থ হতে থাকবে।’
‘তোমার ধারণা,আমার অফিস পাগল সারাবার কারখানা?’
‘না, তা হবে কেন?’
‘একে উন্মাদ, তার উপর এপিলেপটিক পেশেন্ট, তাকে তুমি আমার এখানে চাকরি দেবার কথা ভাবলে কি করে বল তো?’
‘আর ভাবব না ফুপা।এখন তাহলে যাই?’
‘যাও। খবর্দার, বাসায় আসবে না।’
‘বাদল আছে কেমন?’
‘ও ভালই আছে। তোমার প্রভাব থেকে দুরে আছে, ভাল না থাকার তো কোনো কারণ নেই।’
‘আমি কি ওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে পারি ফুপা? অনেক দিন দেখি না—কথা বলতে ইচ্ছা করে।’
‘অসম্ভব! টেলিফোন করতে পারবে না। একেবারেই অসম্ভব।’
‘বলব—ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে টেলিফোন করা হচ্ছে। মিনিট দুই কথা বলব। দু’মিনিটে কী আর হবে।’
‘কিছু হবার থাকলে দু’ মিনিট হবে। বাদলের মাথা খারাপ হয়েই আছে—ঠিক করার চেষ্টা করছি। তোমার টেলিফোন পেলে—আরঠিক হবে না। হিমু, তুমি বিদেয় হও। ক্লিয়ার আউট। এখনথাক কোথায়?’
কোথায় থাকি বলতে যাচ্ছিলাম, ফুপা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, থাক, বলতে হবে না।জানতে চাচ্ছি না।
আমি ঘর ছেড়ে বেরুবার আগে বললাম, ফুপা। বাদলের ব্যাপারে একটা ক্ষুদ্র সমস্যা হতে পারে। ঐ সমস্যাটা নিয়ে কি ভেবেছেন?
‘কি সমস্যা?’
‘আমি জেলে আছি শুনে সেও ভাবতে পারে জেলে যাওয়াটা প্রয়োজনীয়। কাজেই জেলে যাবার একটা চেষ্টা করতে পারে।’
ফুপার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। আমি চলে এলাম। মজনু ‍মিয়ার ভাতের হোটেলে যেতে হবে। ভাতের বিল দিতে হবে। অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে।
মজনু মিয়া হোটেলে খুব ভিড়। প্রচুর কাস্টমার। সবার জায়গা হচ্ছে না। কেউ—কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মজনু মিয়া টাকা গুনতে হিমশিম খাচ্ছে। আমাকে দেখে শীতল গলায় বলল, ভাইজান, কথা আছে।
‘কি কথা—সাধারণ না প্রাইভেট?’
‘প্রাইভেট।’
আমি প্রাইভেট কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়েথাকতে হচ্ছে। মজনু মিয়া তার ছোট ভাইটাকে ক্যাশে বসিয়ে এগিয়ে এল। আমি বললাম, খুব ভাল বিজনেস হচ্ছে, মজনুমিয়া। ব্যাপার কি?
‘ব্যবসাপাতি হইল আপনার ভাগ্যের ব্যাপার। কখন কি হয় কিছু বলা যায় না। কয়েকদিন ধরে দেখতেছি আমার সামনের হোটেলের সব বান্ধা কার্স্টমার এইখানে আসতেছে।’
‘বয়-বাবুর্চি তো বাড়াতে হবে। এরা পারছে না। আরো কয়েকজন নিন।’
‘দেখি।’
‘আর এদের বেতন বাড়িয়ে দিন।’
‘বাজে কথা বলবেন না তো হিমু ভাই। বাজে কথা শুনেতে ভাল লাগে না।’
‘আচ্ছা যান। বাজে কথা বলব না। আপনার প্রাইভেট কথা শুনব। প্রাইভেট কথাটা কি?’
‘আপনি যে আপনার এক ভাগ্নেকে গছায়ে দিয়ে গেলেন—তার আছে মৃগী বেরাম। ঐ দিন দুপুরে শরীর কাঁপতেকাঁপতে পড়ে গেল। কেলেঙ্কারি অবস্থা। কার্স্টমাররা সব খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে।’
‘তাতে অসুবিধা কী?’
‘অসুবিধা আছে না? এইরকম রোগী নিয়ে কারবার করলে তো হবে না ভাইজান। দোকানের বদনাম হবে। লোক আসা কমে যাবে। আপনে উনারে আমার দোকানে আসতে নিষেধ করে দেবেন।’
‘আচ্ছা, নিষেধ করে দেব।’
‘আপনি রাগ হলেও কিছু করার নাই। আপনার জন্যে সব মাপ। কিন্তু হিমু ভাই—পাগল, ছাগল, মৃগীরোগী এদের আমি দোকানে ঢুকাব না। ঐদিন আপনার ভাগ্নেরে দেখে আমি কানে হাত দিয়েছি। অনেক কাস্টমার বাইরে দাঁড় হয়েছিল। গণ্ডগোল দেখে ভিতরে ঢুকে নাই। আপনার ভাগ্নেরে আমি বলে দিয়েছি আর যেন এখানে না আসে।’
‘আপনি নিজেই বলে দিয়েছেন?’
‘জ্বি ভাইজান, আমি বলেছি। মৃগীরোগী আমার দরকার নেই।’
‘আমি পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললাম, রুগ্ন মানুষের প্রতি মমতা দেখানোর বদলে আপনি দেখাচ্ছেন ঘৃণা। এটা কি ঠিক হচ্ছে? রোগটা তো আপনারো হতো পারত। তা ছাড়া এই যে আজ আপনার দোকানে এত বিক্রি বেড়েছে, হয়তো আমার ভাগ্নের কারণেই বেড়েছে। এই ক’দিন তাকে যত্ন করে খাইয়েছেন বলেই বেড়েছে। এখন তাকে বিদেয় করে দিয়েছেন—দেখা যাবে হুট করেবিক্রিবাটা পড়ে যাবে।’
‘আমাকে ভয় দেখায়ে লাভ নাইহিমু ভাই। আমি ভয় খাওয়ার লোক না। ঐ মৃগীরোগী আমি আরদোকানে ঢুকতে দেব না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
‘আপনি মনে কিছু নিবেন না হিমু ভাই। আপনার জন্যে আমি আছি।অন্য কারো জন্যে না।’
আমি মজনু মিয়ার টাকাপয়সা মিটিয়ে মোরশেদ সাহেবের খোঁজে গেলাম। খিলগাঁয়ে তাঁর বাড়িতে তাঁকে পাওয়া গেল না। ঘর তালাবন্ধ। বাড়িওয়ালাকে খুঁজে বের করলাম। বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি আমাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই ঘরে নিয়ে বসালেন। বললেন,
উনি বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। আমি বললাম, কোথায় আছে জানেন?
‘জ্বি-না।’
‘বাসা ছেড়েছেন কবে?’
‘গত পরশু। দু’ মাসেরভাড়া পাওনা ছিল। উনি ভাড়াটাড়া সব মিটিঁয়ে দিয়ে গেছেন। আমি বললাম, থাক্, ভাড়া দিতে হবে না। বাদ দেন। রাজি হলেন না।’
‘জিনিসপত্রগুলি কোথায়?’
‘জিনিসপত্রগুলি কিছু তো ছিল না। একটা খাট, কিছু চেয়ার-টেবিল। ঐসব একটা ঘরে তালা দিয়ে রেখেছি। বলেছি, একসময় এসে নিয়ে যাবেন, কোনো অসুবিধা নাই। ভদ্রলোকের উপর মায়া পড়ে গিয়েছিল, বুঝলেন? ভাল চাকরি করছিল, সুন্দর সংসার—হঠাৎ কি হয়ে গেল দেখেন। সব ছারখার। যাবার সময় বাসার সামনে খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে খুব কাঁদছিলেন। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার বড় বৌমা বলল, বাবা, উনাকে বলেন—বাসা ছাড়ার দরকার নাই। উনাকে থাকতে বলেন। এইগুলা হচ্ছে ভাই ভাবের কথা। সংসার তো ভাই ভাবের কথায় চলে না।’
‘তা তো ঠিকই।’
‘বিনা পয়সায় থাকতে দিলে আমার চলে কী করে। আমি তো এতিমখানা খুলি নাই। এই কথাই বৌমাকে বুঝায়ে বললাম।’
‘উনি কী বললেন?’
‘কিছু বলে নাই। চুপ করে ছিল। লক্ষ্মী মেয়ে। শ্বশুরের মুখের উপর কোনোকথা বলবে না। তারপর শুনি—রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আমি বললাম, ভাত খাও নাই কেন, মা? সে বলল, মানুষটার জন্যে মনটা খুব খারাপ লাগছে বাবা। ভাত খেতে ইচ্ছা করছে না। কি রকম করে কাঁদছিল। যাই হোক, মেয়েছেলের কথা বাদ দেন। মেয়েছেলে বিড়ালের জন্যেও কাঁদে। এখন বলেন আপনি উনার কে হন?’
‘সম্পর্কে মামা হই।’
‘ও আচ্ছা।খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে কথা বলে।’
আমি বললাম, আপনার বড় বৌমাকে একটু ডাকবেন?
‘কেন?’
‘একটু দেখব।ভালমানুষ দেখার মধ্যেও পুণ্য আছে। যদি অসুবিধা না হয় একটু ডাকুন।’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়েই তাঁর বড় বৌমাকে ডাকলেন। সাদাসিধে সরল চেহারার মেয়ে, দু’ বছরের একটা বাচ্চা কোলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কত বয়স হবে মেয়েটির? খুব বেশি হলে উনিশ-কুড়ি। তার কোলের শিশুটিও অবিকল তার মতো দেখতে। মা এবং শিশু যেন একই ছাঁচে তৈরী। আমি বললাম, আপনি কেমন আছেন?
মেয়েটি জবাব দিল না।
আমি বললাম,আপনার ছেলেটার কি নাম রেখেছেন?
মেয়েটি এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। বাচ্চা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বলল, আমার বৌমা খুব লাজুক স্বভাবের। বাইরের কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারে না।
আমি বললাম, আমি কথা বলতে চাইওনি। শুধু দেখেতে চেয়েছি। আচ্ছা ভাই, যাই।
‘আপনার ভাগ্নেকে বলবেন জিনিসপত্র সাবধানে রাখা আছে। যেন চিন্তা না করে।’
‘জ্বি আচ্ছা,বলব। আপনার অনেক মেহেরবানী।’
নীতুর একটি চিঠি এসেছে। নীতুর স্বভাবও দেখা যাচ্ছে ইয়াদের মতো। চিঠি পাঠিয়েছে ইংরেজিতে টাইপ করে। ডাকে পাঠায়নি, হাতে-হাতে পাঠিয়েছে। নীতুর ম্যানেজার চিঠি নিয়ে এসেছে। তার উপর নির্দেশ, চিঠি আমার হাতে দিয়ে অপেক্ষা করবে এবং জবাব নিয়ে যাবে।
বড়লোকের ম্যানেজার শ্রেণীর কর্মচারীরা নিজের প্রভু ছাড়া সবার উপর বিরক্ত হয়ে থাকে। এই ভদ্রলোককে দেখলাম মহা বিরক্ত। প্রায় ধমকের স্বরে বলল, কোথায় থাকেন আপনি?
‘কেন বলুন তো?’
‘এই নিয়ে দশবার এসেছি। বসে যে অপেক্ষা করব সেই ব্যবস্থাও নেই। মেসের অফিস বন্ধ। একজনকে বললাম একটা চেয়ার এনে দিতে, সে আচ্ছা বলে চলে গেল। আর তার দেখা নেই।’
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, এর পর যখন আসবেনএকটা ফোল্ডিং চেয়ার সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
ম্যানেজারের মুখ কঠিন হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এ-জাতীয় কথাবার্তা শুনে সে অভ্যস্ত নয়। নীতুর চিঠি বের করে বলল, চিঠিপড়ে জবাব লিখে দিন। আপা বলেছেন—জবাব নিয়ে যেতে।
‘এখন চিঠি পড়েতে পাড়ব না।’
ম্যানেজার হতভম্ব গলায় বলল, এখন চিঠি পড়তে পারবেন না?
‘জ্বি-না।’
‘চিঠি আপা পাঠিয়েছেন।’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আপাই পাঠাক আর দিদিমণিই পাঠাক, চিঠি এখন পড়ব না।
‘কখন পড়বেন?’
‘তাও তো বলতে পারছি না। আমার মাথাধরা রোগ আছে। খারাপ ধরনের মাথাধরা। এখন সেটা শুরু হয়েছে। আমি খুব ঠাণ্ডা পানিতে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করব। তারপরদরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখিমাথাব্যথা সেরেছে, তখন পড়তে পারি। আবার নাও পারি।’
‘জরুরি চিঠি।’
‘আমার ঘুমটা চিঠির চেয়েও জরুরি। আপনি বরং এক কাজ করুন, এখন চলে যান। রাতে একবার খোঁজ নেবেন।’
‘আপাকে কি বলব আপনি চিঠি পড়তে চাচ্ছেন না?’
আমি ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকালাম, সে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। মানুষজন দ্রুত বদলে যাচ্ছে—সবাই ভয় দেখাতে চায়। ভয় দেখিয়ে কাজ সারতে চায়।
কেউভয় দেখালে উল্টা তাকে ভয় দেখাতে ইচ্ছা করে। ম্যানেজার ব্যাটাকে চুড়ান্ত রকমের ভয় কী করে দেখানো যায়? মাথায় কিছুই আসছে না। ম্যানেজার কঠিন মুখ করে বলল, আমিকি উনাকে বলব যে উনি বলেছেন যখন উনার ইচ্ছা হয় তখন পড়বেন। এখন ইচ্ছা হচ্ছে না।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, বলতে পারেন।
‘আচ্ছা, বলব।’
‘চিঠিটা সঙ্গে করে নিয়ে যান। রাতে যখন আসবেন তখন নিয়ে আসবেন।’
‘আপনি কাজটা ঠিক করছেন না।’
‘সবাই তো আর ঠিকঠাক কাজ করে না। কেউ-কেউ ভুলভাল কাজ করে। আমি ভুলভাল কাজ করতেই অভ্যস্ত। আপনি চিঠি নিয়ে চলে যান।’
‘জ্বি-না, আমি অপেক্ষা করব।’
‘বেশ, অপেক্ষা করুন। আমার ঘরে একটা চেয়ার আছে। বের করে নিয়ে যান। বারান্দায় বসুন। শুভ বিকাল।’
আমি চেয়ার বের করে দিলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারলাম। ম্যানেজার বসে আছে মূর্তির মতো।আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। দরজা না খুলেই ডাকলাম, ম্যানেজার সাহেব।
‘জ্বি?’
‘আপনি এখনো আছেন?’
‘জ্বি।’
‘সঙ্গে গাড়ি আছে?’
‘আছে।’
‘তাহলে তরঙ্গিণী স্টোরে চলে যান। একটা বল পয়েন্ট কিনে আনবেন। চিঠির জবাব লিখতে হবে। আমার কাছে একটা বল পয়েন্ট আছে। দশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম—লেখা দিচ্ছে না।’
‘আমার কাছে কলম আছে।’
‘আপনারকলমে কাজ হবে না। আমাকে লিখতে হবে নিজের কলমে।’
‘তরঙ্গিণী স্টোর থেকেই কিনতে হবে?’
‘জ্বি।’
‘স্টোরটা কোথায়?’
‘বলছি। আপনার কাছে বল পয়েন্টের দাশ হয়ত তিন টাকা চাইবে কিন্তু আপনি দেবেন দশ টাকা। নিতেনা চাইলে জোর করে দেবেন।’
ম্যানেজার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,জ্বি আচ্ছা, দেব। আপনি দয়া করে। চিঠিটা পড়ুন।তার কঠিন ভাব এখন আর নেই। এখন সে ভীত চোখেই আমাকে দেখছে।
আমি দরজা খুলে চিঠি নিলাম। ম্যানেজার সাহেবকে তরঙ্গিণী স্টোরটা কোথায় বুঝিয়ে বললাম। ভদ্রলোক আরএকবার বলল, অন্য কোনো জায়গা থেকে কিনে আনলে হবে না?
আমি কঠিন গলায় বললাম, না।
নীতু লিখেছে—
হিমু সাহেব,
আশা করি সুখে আছেন। অবশ্যি আমার আশা করা না করায় কিছু যায় আসে না। আপনি সব সময় সুখেই থাকবেন, এবং আপনার আশেপাশের মানুষদের নানানভাবে বিভ্রান্ত করবেন, বিপদে ফেলবেন। অন্যদের সমস্যায় ফেলাতেও সুখ আছে। সেই সুখের ঘাটতি আপনার কখনো হয় না।
আপনি নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে জেনেছেন যে আপনার বন্ধু অবশেষে আপনার সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তিনি ভিখিরি হয়েছেন। ভিখিরির মতো সাজসজ্জা করে পথে-পথে ঘুরছেন।এমন হাস্যকর ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা কোনোদিনও কল্পনা করিনি।ইয়াদ বুদ্ধিমান নয় এই তথ্য আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। কিন্তু ও যে কতটা বোকা তা আপনিই চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখালেন।
ইয়াদের আত্মীয়স্বজনদের আমি বলেছি ব্যাপারটা আর কিছুই না,
ইয়াদের একধরনের খেলা। ওরা ব্যাপারটা সেভাবেই নিয়েছে, এবং বেশ মজাও পাচ্ছে। কিন্তু আমি তো জানি ব্যাপারটা খেলা হলেও আপনার জন্যে খেলা,ইয়াদের জন্যে নয়। আপনি যে খেলা খেলছেন তা হল dangerous game. আশা করি আপনি জানেন খেলা কোথায় শেষ করতে হয়।
আমি দু’জন লোক ইয়াদের পেছনে লাগিয়ে রেখেছি। ওরা সব সময় তার দিকে লক্ষ রাখছে। আমার ধারণা ছিল, দু’দিন পারহবার আগেই ওর মোহভঙ্গ হবে এবং সে বাড়িতে ফিরে আসবে।আমাকে জোর খাটিয়ে কিছু করতে হবে না। কিন্তু সে বাসায় ফিরছে না। আপনি এই চিঠি পাওয়ামাত্র এমন ব্যবস্থা করবেন যেন সে বাড়িতে ফিরে আসে। আমি একটি ব্যাপার খুব পরিষ্কার করে আপনাকে জানাতে চাই, তা হল—ও বোকা হোক, যা হোক, ওকে আমি অসম্ভব ভালবাসি।
ভালবাসা মাপার যন্ত্র বের হয়নি। বের হলে আমার ভালবাসার পরিমাণ আপনাকে মেপে দেখাতাম। ওর কোনোরকম ক্ষতি আমি সহ্য করব না।কাউকে সেই ক্ষতি করতেও দেব না। ও কোথায় রাত্রি যাপনকরে তা আমাদের ম্যানেজার সাহেব জানেন। উনিই আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবেন।
ওর মাথা থেকে ভূত সরিয়ে আপনি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন এবং আর কোনোদিনও ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না।আপনার জন্যে এই কাজ কঠিন নয়, বেশ সহজ।এই সহজ কাজের জন্যে আমি অনেক বড় মূল্যে দিতে প্রস্তুত আছি। Tell me price.

আরো কিছু কথা বলার ছিল, ক্লান্ত বোধ করছি।
নীতু
আমি চিঠি শেষ করে ডাকলাম, ম্যানেজার সাহেব।
ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, জ্বি স্যার।
‘আপনাকে কি চিঠির জবাব নিয়ে যেতে বলেছে?’
‘জ্বি।’
‘বল পয়েন্ট এনেছেন?’
‘জ্বি।’
‘কত নিয়েছে?
‘চার টাকা চেয়েছিল—আপনি দশ টাকা দিতে বলেছেন, দিয়েছি। নিতে চাচ্ছিল না। আপনার কথা বলে জোর করে দিয়ে এসেছি।’
‘ভাল করেছেন।’
‘আপনি কি চিঠির জবাব দেবেন?’
‘না। তবে আপনাকে নিয়ে ইয়াদের খোঁজে যাব। চলুন যাওয়া যাক।’
‘এখন গেলে উনাকে পাওয়া যাবে না। উনার একটা ‍ঘুমাবার জায়গা আছে— রাত এগারোটায় দিকে সেখানে ফেরেন।’
‘তাকে কি এখন ভিখিরির মতো লাগে?’
‘জ্বি, লাগে।’
‘ভিক্ষা শুরু করেছে?’
‘জ্বি-না।’
‘চলছে কীভাবে?’
‘তা ঠিক জানি না। কিছু টাকাপয়সা নিয়ে বের হয়েছিলেন বলে মনে হয়।’
‘খাওয়াদাওয়া করছে?’
‘প্রথম দিন কিছু খাননি। রাতে একটা পাউরুটি খেয়েছেন।’
‘তারপর?’
‘আমি শুধু প্রথম দিনের খবর জানি।’
‘ওর দিকে লক্ষ রাখার জন্যে লোক রাখা আছে না?’
‘জ্বি-আছে।’
‘ম্যানেজার সাহেব, আপনি নিজে কি খাওয়া-দাওয়া করেছেন, নাদুপুর থেকে এখানেই বসে আছেন?’
‘খাইনি কিছু।’
‘যান, খেয়ে আসুন।’
‘জ্বি-না।’
‘না কেন?’
ম্যানেজার জবাব দিল না। আমি বললাম, নীতু কি বলে দিয়েছে আমাকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল না করতে?
‘জ্বি।’
‘তা হলে চলুন। আমার সঙ্গেই চলুন। আপনাকে খাইয়ে আনি।’
‘লাগবে না।’
‘আসুন যাই।’
‘স্যার, কিছু খাব না।’
রাত এগারোটায় ইয়াদের সন্ধ্যানে বের হলাম।
ইয়াদ থাকে মীরপুর দশ নম্বরে, সিঅ্যান্ডবি গুদামে। গুদামের ভেতর গাদাগাদি করে রাখা রাস্তার কালভার্টের সিরামিক স্ল্যাব। দেখতে বিশাল আকৃতির সিলিন্ডারের মতো। তার একটিতে ইয়াদের সংসার। বাইরে থেকে ইয়াদবলে ডাকতেই সে খুশি-খুলি গলায় বলল, চলে আয়। মাথা নিচু করে ঢুকবি। দাঁড়া এক সেকেণ্ড, বাতি জ্বালাই। সে কুপি জ্বালল। আমি ঢুকলাম। ভক করে খানিকটা পচা দুর্গন্ধ নাকে ঢুকল।
‘গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে রে ইয়াদ।’
‘প্রথম খানিকক্ষণ গন্ধ পাবি। তারপর পাবি না। মাথা নিচু করে ঢোক।’
সিলিন্ডার স্লাবের এক মাথা পলিথিন দিয়ে মোড়ানো, অন্য মাথায় চটের পর্দা। নিচে পুরানো একটো কম্বল লম্বালম্বি বিছানো। কম্বলের উপর ইয়াদহাসিমুখে বসে আছে।
‘তুই আসবি জানতাম। ইচ্ছা করেইতোকে খবর দিইনি। তুই হচ্ছিস গ্রে হাউন্ড টাইপ। গন্ধশুঁকে-শুঁকে চলে আসবি। আমার সংসার কেমন দেখছিস?’
‘মন্দ না।’
‘মন্দ না মানে? একসেলেন্ট। শীত টের পাচ্ছিস?’
‘না।’
‘পুব-পশ্চিমে মুখ করা। উত্তরী বাতাস ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই। মশা লাগছে?’
‘না।’
‘এক মুখ পলিথিন দিয়ে ঢাকা, অন্য মুখে চটের পর্দা। মশা ঢোকার কোনো উপায় নেই।’
‘এরকম আরামের জায়গার খোঁজ পেলি কোথায়?’
‘এরচেয়েও আরামের জায়গা আছে।ভাড়া বেশি।’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ভাড়া দিতে হয়!
‘অবশ্যই দিতে হয়।’
‘এর ভাড়া কত?’
‘দু’ টাকা।’
‘মাসে দু’ টাকা?’
ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বলল, তুই পাগলটাগল হয়ে গেলি? শায়েস্তা খাঁর আমল ভেবেছিস? পার নাইট দু’টাকা। শীতকালে চার্জ বেশি। গরমকালে পার নাইট এক টাকা। মাসচুক্তির কোনো ব্যাপার নেই।
‘ভাড়া নেয় কে?’
‘সর্দার আছে। সর্দার নেয়। সিঅ্যান্ডবি-বদারোয়ান নেয়, পুলিশ নেয়, অনেক ভাগাভাগি। পুরোপুরি জানি না।’
‘দু’টাকা ভাড়া দিয়ে কেউ থাকে?’
‘অবশ্যই থাকে। কোনটা খালি নেই। তা ছাড়া অনেক স্পেস। কোনো-কোনটায় পুরো ফ্যামিলি আঁটে। চা খাবি?’
‘তোর এখানে কি চা বানাবার ব্যাবস্থা আছে?’
‘আরে না। তবে কাছেপিঠেই আছে। ডাক দিলে দিয়ে যাবে। চা, সিগারেট, পান।’
‘সুখে আছিস মনে হয়।’
‘অবশ্যিই সুখে আছি। কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা নেই। কে কি বলল তা নিয়ে মথাব্যাথা নেই—কী আরামের ঘুম যে হয়, তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। আমার কি মনে হয় জানিস? আরামের ঘুম কী জিনিস এটা জানার জন্যেই আমাদের সবার কিছুদিনের জন্যে হলেও ভিখিরি হওয়া উচিত। তার উপর ভিখিরিদের মধ্যে কমিউনিটি ফিলিং যা আছে তারও তুলনা নেই। বাইরে থেকে আমাদের মনে হয় এক ভিখিরি অন্য ভিখিরিকে দেখতে পায় না, এটা খুবই ভুল কথা।সবাই সবার খোঁজ রাখে। ধর্, সিগারেট খা।’
‘সিগারেটধরেছিস?’
‘হুঁ, ধরেছি। হাইকোর্ট মাজারের কাছে একরাতে গাঁজা খেয়েছি। দু’টান দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। উঠলাম সকালে—হা হা হা।’
ইয়াদ গা দুলিয়ে হাসতে লাগল। আমি বললাম, নীতুর কথা মনে হয় না?
ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না।
‘একেবারেই না?’
‘উহু। তুই বলায় মনে পড়ল।’
‘ও কেমন আছে জানতে চাস না?’
‘ভাল আছে তো বটেই। খারাপ থাকবে কেন?’
‘তোর আসল কাজকেমন এগুচ্ছে?’
‘এগুচ্ছে না। অবশ্যি আমি নিজেই গা করছি না। তাড়া তো কিছু নেই। হোক ধীরেসুস্থে। আগে ওদের মেইন স্ট্রীমের সঙ্গে মিশে নিই—তারপর।’
‘ওদের মেইন স্ট্রীমের সঙ্গে এখানো মিশতে পারিসনি?’
‘উহু।ওরা খুব চালাক, বুঝলি হিমু, চট করে ধরে ফেলে যে আমিওদের একজন না। বাইরের কেউ।’
‘কিছু বলে না?’
‘না, কিচ্ছু বলে না। চুপ করে থাকে। তবে আমার মতো অনেকেই আছে।’
‘বলিস কী।’
‘নানান ধাক্কায় ভিখিরি সেজে ঘোরে। বিদেশী আছে বেশ কয়েকটা। এর মধ্যে একটা আছে নেদারল্যান্ডের, বিরাট চোর। চা খাবি কিনা তা তো বললি না। খাবি?’
‘খাব।’
ইয়াদ চটের পর্দা সরিয়ে ডাকল, তুলসী, তুলসী, দু’টা চা।
‘তুলসীকে দেখে রাখ্—অসাধারণ একটা মেয়ে। আমি আমার জীবনে এত ভাল মেয়ে দেখিনি—কী যে বুদ্ধি, তোকেও সে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে ফেললে তুই টেরও পাবি না।’
‘তুলসীর বয়স কত?’
‘সাত-আট হবে। বেশি না।’
‘ও কি ভিক্ষা করে?’
‘গাবতলি বাসস্ট্যান্ডে চা বিক্রি করে। তুলসীর বাবা আর সেদু’জনের ব্যবসা। ভাল রোজগার।’
তুলসী চা নিয়ে ঢুকল। মেয়েটার গায়ে সুন্দর গরম স্যুয়েটার। মাথার চুল লাল। স্বর্ণকেশী বালিকা। ইয়াদ বলল, তুলসী হল আমার খুবইক্লোজ ফ্রেন্ড।
তুলসী আড়চোখে আমাকে দেখল, কিছু বলল না। ইয়াদ বলল, চায়ের কাপ থাক্, পরে নিয়ে যাবি। হিমু, তুলসীকে কেমন দেখলি?
‘ভাল।’
‘মারাত্মক বুদ্ধি! কি করে বুঝলাম জানিস? তুলসী আমাকে বলল, দু’জন লোক আমার উপর নজর রাখছে। আমি কিচ্ছু বুঝিনি।’
‘দু’জনতাহলে তোর উপর নজর রাখছে?’
‘হুঁ। নীতুর কাণ্ড। আমাকে সারাক্ষণ চোখে-চোখে রাখা হল ওর অভ্যাস। কোনোদিনদেখব টুটি-ফুটিকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।’
‘উপস্থিত হলে কি করবি?’
ইয়াদ গম্ভীর গলায় বলল, সত্যি সত্যিউপস্থিত যদি হয়, তাহলে বলব, আমার সঙ্গে থেকে যাও নীতু।
‘কি মনে হয় তোর, নীতু থাকবে?’
‘কিছু বলা যায় না, থাকতেও পারে। এখানে থাকাটা কিন্তু আরামদায়ক। এক রাত থেকে যা, তু্ই নিজেই টের পাবি। থাকবি?’
‘উঁহু, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
‘কুপির ধোঁয়ায় দম বন্ধ হচ্ছে। কুপি নিভিয়ে দিলেই দেখবি—আরাম।’
ইয়াদ ফুঁদিয়ে কুপি নিভিয়ে দির চারদিকে ঘন অন্ধকার । এমন অন্ধকার আমি আমার জীবনে দেখিনি।’
‘হিমু।’



No comments