এবং হিমু - ৪র্থ অংশ
এবং হিমু ৪র্থ অংশ
গুলশান এলাকায় সবচে’ বড়, সবচে’ কুৎসিত বাড়িটা রেশমা খালার। খালু সাহেব গনি মিয়ার সিক্সথ ছিল অকম্পনীয়। তিনি সস্তা গণ্ডার সময়ে গুলশানে দু’বিঘা জমি কিনে ফেলে রেখেছিলেন। তাঁর বেকুবির উদাহারণ হিসেবে তখন এই ঘটনার উল্লেখ করা হত। যার সঙ্গেই দেখা হত রেশমা খালা বলেতেন,বেকুবটার কাণ্ড শুনেছে? জঙ্গল কিনে বসে আছে। খালু সাহেবের চেহারা বেকুবের মতই ছিল। অন্যের কথা শোনার সময় আপনাআপনি মুখ হয়ে যেত। ব্যবসা বিষয়ে যেসব কথা বলতেন সবই হাস্যকর বলে মনে হত। যে বছর দেশে পেয়াজের প্রচুর ফলন হল এবং পেয়াজের দাম পড়ে গেল সে বছরই তিনি পেয়াজের ব্যবসায় চলে এলেন। ইণ্ডিয়া থেকে পেয়াজ আনার জন্যে এলসি খুললেন। অন্য ব্যবসায়ীরা হাসলেন। হাসারই কথা। রেশমা খালা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি না-কি বেকুবের মত পিয়াজের ব্যবসায় নামছ? যত দিন যাচ্ছে তোমার বুদ্ধি-শুদ্ধি তো ততই চলে যাচ্ছে। আগে মাঝে মধ্যে হা করে থাকতে, এখন দেখি সারাক্ষণই হা করে থাক। পেয়াজের ব্যবসার এই বুদ্ধি তোমাকে কে দিল? কেউ দেয় নাই। নিজেরই বুদ্ধি। পেয়াজের ফলন খুব বেশি হয়েছে তো, চাষী ভাল দাম পায় নাই। এই জন্য আগামী বছর পেয়াজের চাষ হবে কম। পেয়াজের দাম হবে আকাশছোঁয়া।’ ‘তোমার মাথা।’ ‘দেখ না কি হয়।’ গনি সাহেব বললেন তাই হল। পরের বছনর পেয়াজ দেশে প্রায় হলই না। রেশমা খালা হতভম্ব। তিনি বলে বেড়াতে লাগলেন,বেকুব মানুষ তো। বেকুব মানুষর উপর আল্লাহর রহমত থাকে। যে ব্যবসা-ই করে দু’হাতে টাকা আনে। টাকা ব্যাংকে রাখার জায়গা নেই, এমন অবস্থা। রেশমা খালার আফসোসের সীমা নেই—বেকুব স্বামী টাকা রোজগার করাই শিখেছে, খরচ করা শেখেনি। তিনি আফসোসের সঙ্গে বলেন, টাকা খরচ করতে তো বুদ্ধি লাগে। বুদ্ধি কোথায় যে খরচ করবে? খালি জমাবে। গনি সাহেব মাছ-গোশত এক সঙ্গে খান না। ছোটবেলায় তাঁর মা বলেছেন, মাছ-গোশত এক সঙ্গে খেলে পেটের গণ্ডগোল হয়। সেটাই মাথায় রযে গেছে। গাড়িতে চড়তে পারেন না,বেবী টেক্সিতেও না। পেট্টোলের গন্ত সহ্য হয় না। বমি হয়ে যায়। লোকজনের গাড়ি থাকে। গনি সাহেবের আছে রিক্সা। সেই রিকশার সামনে-পেছনে ইংরেজিতে লেখা“Private” সেই রিকশায় কোথাও যেতে হলে রেশমা খালার মাথা কাটা যায়। সাধারণ রিকশায় চড়া যায়, কিন্তু, ‘প্রাইভেট লেখা রিকশায় কি চড়া যায়? লোকজন কেমন কেমন চোখে তাকায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রেশমা খালা গাড়ি কিনলেন। খালু সাহেব নাকে অডিকোলন ভেজানো রুমাল চাপা দিয়ে কয়েকবার সেই গাড়িতে চড়লেনও, তারপর আবার ফিরে গেলেন প্রাইভেট রিকশায়। তাঁতে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের কোন অসুবিধা হল না। ব্যবসা-বাণিজ্যে হু-হু করে বাড়তে লাগল। কাপড়ের কল দিলেন, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি করলেন। রেশমা খালার শুধু আফসোস—খালি টাকা, আর টাকা। কি হবে টাকা দিয়ে? একবার দেশের বাইরে যেতে পারলাম না। এমন এক বেকুব লোকের-হাতে পড়েছি, আকাশে প্লেইন দেখলে তার বুক ধড়ফড় করে। এই লোককে নিয়ে জীবনে কোনদিন কি বাইরে যেতে পারব? কোন দিন পারব না। লোকে ঈদের শপিং করতে সিঙ্গাপুর যায়, ব্যাংকক যায়। আর আমি কোটিপতির বউ, আমি যাই গাউছিয়ায়। খালু সাহেবের মৃত্যুর পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন যে কি পরিমাণ হয়েছে সেটা তাঁর বাড়িতে ঢুকে দেখলাম। পুরোনি বাড়ি ভেঙে কি হুলস্থুল করা হয়েছে। মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। ময়লা জুতা পায়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ভয় লাগে। ঘরে ঘরে ঝাড়বাতি। ড্রয়িংরুমে ঢুকে আমি হতভম্ব গলায় বললাম, সর্বনাশ! রেশমা খালা আনন্দিত গলায় বললেন, বাড়ি রিনোভেশনের পর তুই আর আসিসনি, তাই না? ‘না। তুমি তো ইন্দ্রপুরী বানিয়ে ফেলেছে।’ ‘আর্কিটেক্টটা ভাল পেয়েছিলাম। টাকা অনেক নিয়েছে। ব্যাটা কাজ জানে, টাকা তো নিবেই। ভেতরের সব কাজ দিয়েছি ইন্টারনাল ডিজাইনারকে। আমেরিকা থেকে পাশ করা ডিজাইনার। ফার্নিচার-টানির্চার সব তার ডিজাইন। দেয়ালে যে পেইনটিংগুলি দেখছিস সেগুলিও কোন্টা কোথায় বসবে সে-ই ঠিক করে দিয়েছে। ‘এই বাড়িতে তো খালা আমি থাকতে পারব না। দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। এখনি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’ রেশমা খালা আনন্দিত গলায় বললেন, তোর ঘর কি দেখিয়ে দি। ঘর দেখলে তুই আর যেতে চাইবি না। গেস্টরুম আছে দু’টা। তোর যেটা পছন্দ সেটাতে থাকবি। একটায় ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচার, অন্যটায় মর্ডান। তোর কোন ধরনের ফার্নিচার পছন্দ? দু’টা ঘরই দেখ। যেটা ভাল লাগে। দু’টাতেই এ্যাটাচড বাথ। দু’টাতেই এসি। ‘এত বড় একটা বাড়িতে একা থাকো?’ ‘একা তো থাকতেই হবে, উপায় কি? গোষ্ঠির আত্মীয়স্বজন এনে ঢুকাব? শেষে ঘুমের মধ্যে মেরে রেখে যাবে। সবাই আছে টাকার ধান্দায়। মানুষ দেখলেই আমার ভয় লাগে।’ আমাকে ভয় লাগেছে, না?’ ‘না, তোকে ভয় লাগছে না। তোকে ভয় লাগবে কেন? শো, কোন বেলা কি খেতে চাস বাবুর্চিকে বলবি। রেঁধে দেবে। দু’ জন বাবুর্চি আছে। ইংলিশ ফুডের জন্যে একজন, বাঙালী ফুডের জন্যে একজন।’ ‘চাইনীজ ফুড কে রাঁধে?’ ‘ইংলিশ বাবুচি রাঁধে?’ ‘ইংলিশ বাবুচিই রাঁধে। ও চাইনীজ ফুডের কোর্সও করেছে। রাতে কি খাবি—চাইনীজ?’ ‘তুমি যা খাও তাই খাব।’ ‘তোর যখন চাইনীজ ইচ্ছা হয়েছে তখন চাইনীজ খাব। দাঁড়া, বাবুচিকে বলে দি। এই বাড়ির মজা কি জানিস—কথা বলরা জন্যে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হবে না। ইন্টারকম আছে। বোতাম টিপলেই হল। আয়, তোকে ইন্টারকম ব্যবহার করা শিখিয়ে দি।’ ইন্টারকম ব্যবহার করা শিখলাম। বাথরুমের গরম পানি, ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা শিখলাম। এসি চালানো শিখলাম। রিমেট কনট্ট্রোল এসি। বিছানায় শুয়ে শুয়েও বোতাম টিপে এসি অন করা যায়। ঘর আপনাআপনি ঠাণ্ডা-গরম হয়। ‘তোর গান-বাজনার শখ আছে? একটা মিউজিক রুম রয়েছে, ক্যাসেট ডেক, সিডি প্লেয়ার সব আছে।’ ‘আর কি আছে?’ ‘প্রেয়ার রুম আছে।’ ‘সেটা কি?’ ‘প্রের্থনা ঘর। নামাজ পড়তে ইচ্ছা হলে নামাজ পড়বি। দেখবি? দেখতে হলে অজু করে ফেল। অজু ছাড়া নামাজ ঘরে ঢুকা নিষেধ।’ ‘নামাজ ঘরে কি আছে? জায়নামাজ টুপি?’ ‘আরে না। জায়নামাজের দরকার নেই। মেঝে সবুজ মার্বেলের। রোজ একবার সাধারণ পানি দিয়ে মোছা হয়, তারপর গোলাপ জল মেশানো পানি দিয়ে মোছা হয়। চারদিকে কোরান শরীফের বিভিন্ন আয়াত ফ্রেমে বার্ধিয়ে রেখেছি। ইসলামিক আর্চ ডিজাইন। এই ডিজাইন আবার অন্য একজনকে দিয়ে করেছি।’ ‘নামাজ পড়ছ?’ ‘শুরু করব। ছোটবেলায় কোরান শরীফ পড়া শিখেছিলাম, তারপর ভুলে গেছি। কথায় বলে না—অনভ্যাসে বিদ্যা নাশ। ঐ হয়েছে। একজন মওলানা রেখে কোরান শরীফ পড়া শিখে তারপর নামাজ ধরব। আয়, নামাজ ঘর দেখে যা। বাংলাদেশে এই জিনিস আর কারো ঘরে নাই। এখন আবার অনেকেই আমার ডিজাইন নকল করেছে। প্রেয়ার রুম বানাচ্ছে। নকলবাজের দেশ। ভাল কিছু করলেই নকল করে ফেলে।’ ‘তোমার বাড়িতে বার নেই খালা?’ ‘আছে, থাকবে না কেন? বার ছাড়া কোন মর্ডান বাড়ির ডিজাইন হয়? ছাদের চিলেকোঠায় বার। তোর আবার ঐসব বদ অভ্যাস আছে নাকি? থাকলে ভুলে যা। আমার বাড়িতে বেলেল্লাপনা চলবে না। যা, অজু করে আয়, তোকে নামাজ ঘর দেখিয়ে আনি।’ অজু করে নামাজঘর দেখতে গেলাম। খালা মুগ্ধ গলায় বললেন, ঘরে কোন বাল্ব বা টিউব লাইট দেখেছিস?’ ‘না।’ ‘তারপরেও ঘর আলো হয়ে আছে না?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘এর নাম কনসিলড লাইটিং। বাঁদিকের দেয়ালে দেখ একটা সুইচ, টিপে দে।’ ‘টিপলে কি হবে?’ ‘টিপে দেখ না। বিসমিল্লাহ বলে টিপবি।’ আমি বিসমিল্লাহ বলে সুইচ টিপে আতংক নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার ধারণা, সুইচ টেপামাত্র নামাজঘর পুরোপুরি পশ্চিম দিকে ঘুরবে। তা হল না। যা হল সেটাও কম বিস্ময়কর না। কোরান তেলাওয়াত হতে লাগল। রেশমা খালা বললেন, পুরো কোরান শরীফ রেকর্ড করা আছে। একবার বোতাম টিপে দিলে অটোমেটিক কোরান খতম হয়ে যায়। ‘সেই কোরান খতমের সোয়াব তো তুমি পাও না, সোয়াব পায় তোমার ক্যাসেট রেকর্ডার। এই ক্যাসেট রেকর্ডারের বেহেশতে যাবার খুবই উঁচু সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে।’ ‘খবরদার, নামাজঘরে কোন ঠাট্টা-ফাজলামি করবি না।’ নামাজঘরে কোরান পাঠ চলতে লাগল। খালা আমাকে ছাদের চিলেকোঠায় বার দেখাতে নিয়ে গেলেন। শ্বেত পাথরের কাউন্টার টেবিল। পেছনে আলমারী ভর্তি নানা আকারের এবং নানা রঙের বোতল ঝিকমিক করছে। ‘কালেকশান কেমন, দেখেছিস?’ ‘হুঁ। আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। শুধু আক্কেল গুড়ুম না, একই সঙ্গে বে-আক্কেল গুড়ুম।’ ‘বে-আক্কেল গুড়ুম আবার কি?’ ‘কথায় কথা আর কি! করেছ কি তুমি? দুনিয়ার বোতল জোগাড় করে ফেলেছ।’ ‘খাওয়ার লোক নেই তো। শুধুই জমছে।’ ‘তোমার এখানে সবচে’ দামী বোতল কোন্টা খালা?’ ‘পেটমোটা বোতলটা—ঐ যে দেখে মনে হচ্ছে মাটির বোতল। পঞ্চাশ বছরের পুরানো রেড ওয়াইন। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের বিশেষ বিশেষ উৎসবে এই জিনিস খাওয়া হয়।’ ‘দাম কত তা তো বললে না।’ ‘দাম শোনার দরকার নেই। দাম শুনলে তুই ভিরমি খাবি।’ ‘এম্নিতেই ভিরমি খাচ্ছি। আজ আর আমার ভাত খেতে হবে না। ভিরমি খেয়ে পেট ভরে গেছে। আনন্দে খালার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। আমার মুখ হয়ে গেল অন্ধকার। এক সপ্তাহ এ বাড়িতে থাকা যাবে না। আজই পালাতে হবে। রাতটা কোনমতে পার করে সকালে সূর্য ওঠার আগেই ‘হ্যাপিশ’। ‘আয়, লাইব্রেরি ঘর দেখি।’ ‘আবার লাইব্রেরি ঘরও আছে?’ ‘বলিস কি! লাইব্রেরি ঘর থাকবে না? লাইব্রেরি ঘর পুরোটা কাঠের করেছি। মেঝেও কাঠের। সব রকম বইপত্র আছে; ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুই বই পড়ে কাটাতে পারবি। নিউ মার্কেটের এক দোকানের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে রেখেছি—ভাল ভাল বই এলেই পাঠিয়ে দেয়। লাইব্রেরি ঘরে কম্পউটার বসিয়েছি। তুই কম্পউটার চালাতে জানিস?’ ‘না।’ ‘আমিও জানি না। যাদের কাছ থেকে কিনেছি ওদের বলা আছে, অবসর পেলেই খবর দেবে, ওরা এসে শিখিয়ে দেবে।’ ‘অবসর পাচ্ছ না?’ ‘অবসর পাব কোথায়? সকালটায় একটু অবসর থাকে। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমুতে যাই—সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাই। সারারাত জেগে থাকি—দুপুরে না ঘুমালে চলবে কেন?’ ‘সারারাত জেগে থাক কেন?’ ‘ঘুম না হলে জেগে থাক কেন?’ ‘ঘুম না হলে জেগে থেকে করব কি?’ ‘ঘুম হয় না?’ ‘না।’ ‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’ ‘ডাক্তারের পেছনে জলের মত টাকা খরচ করেছি। এখনো করছি। এখনো চিকিৎসা চলছে। সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসা করছেন।’ ‘তারা কিছু পাচ্ছে না?’ ‘পাচ্ছে কি পাচ্ছে না ওরাই জানে। ওদের চিকিৎসার লাভ হচ্ছে না। এখন তুই হলি ভরসা।’ ‘আমি ভরসা মানে? আমি কি ডাক্তার না-কি?’ ‘ডাক্তার না হলেও তোর নাকি অনেক ক্ষমতা। সবাই বলে। তুই আমাকে রাতে ঘুমের ব্যবস্থা দে। তুই যা চাইবি তা-ই পাবি। ওয়াইনের ঐ বোতলটা তোকে না হয় দিয়ে দেব।’ পঞ্চাশ বছরের পুরানো মদের বোতল পাব এই আনন্দ আমাকে তেমন অভিভূত করতে পারল না। আমার ভয় হল এই ভেবে যে রেশমা খালা আমার উপর ভর করেছেন। সিন্দাবাদের ভূত সিন্দাবাদের উপর একা চেপেছিল। রেশমা খালা আমার উপর এক চাপেন নি, তাঁর পুরো বাড়ি নিয়ে চেপেছেন। একদিনই আমার চ্যাপ্টা হয়ে যাবার কথা। চ্যাপ্টা হওয়া শুরু করেছি। ‘হিমু!’ ‘জ্বি।’ ‘আমার ব্যাপারটা কখন শুনবি?’ ‘তোমার কোন ব্যাপারটা?’ ‘ওমা, এতক্ষণ কি বললাম—রাতে ঘুম না হওয়ার ব্যাপারটা।’ ‘একসময় শুনলেই হবে। তাড়াতো কিছু নেই।’ ‘এখন তুই কি করবি।’ ‘বুঝতে পারছি না। নিজের ঘরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব বলে ভাবছি। যে বিছানা বানিয়েছ শুতে সাহসও হচ্ছে না।’ ‘রেশমা খালা বললেন, বিছানা এমন কিছু না। সাধারণ ফোমের তোষক। তবে বালিশ হচ্ছে পাখির পালকের।’ ‘বল কি?’ ‘খুব এক্সপেনসিভ বালিশ। জ্যান্ত পাখির পাখা থেকে এইসব বালিশ তৈরি হয়। মরা পাখির পালকে বালিশ হয় না।’ ‘একটা পালকের বালিশ জন্যে ক’টা পাখির পালক লাগে?’ ‘কি করে বলব ক’টা—কুড়ি পঁচিশটা নিশ্চয়ই লাগে।’ ‘একটা বালিশের জন্যে তাহলে পঁচিশটা পাখির আকাশে উড়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো?’ ‘আধ্যাত্মিক ধরনের কথা বলবি না তো হিমু। এইসব কথা আমার কাছে ফাজলামীর মত লাগে।’ ‘ফাজলামীর মত লাগলে আর বলব না।’ ‘যা, তুই রেস্ট নে। চা কফি কিছু খেতে চাইলে ইন্টারকমে বলে দিবি।’ ‘তুমি কি বেরুচ্ছ?’ ‘হুঁ। বললাম না সকালে আমি একটু বের হই। দিন রাত ঘরে বসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসবে না। তুই তো এখন বের হবি না?’ ‘না।’ ‘তাহলে তালা দিয়ে যাই।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, তালা দিয়ে যাবে মানে? খালা আমার চেয়েও অবাক হয়ে বললেন, তুই আমার মুল বাড়িতে থাকবি তোকে তালা দিয়ে যাব না? লক্ষ লক্ষ টাকার জিনিস চারদিকে। ‘ঘরে যদি আগূন টাগূন লেগে যায় তখন কি হবে?’ ‘খামাখা আগূন লাগবে কেন? আর যদি লাগে প্রতি ফ্লোরে ফায়ার এক্সটিংগূইসার আছে।’ ‘তালা দেয়া অবস্থায় কতক্ষণ থাকব।’ ‘আমি না আসা পযর্ন্ত থাকবি। আমি তো আর সারাজীবনের জন্যে চলে যাচ্ছি না। ঘণ্টাখানিক ঘোরাঘুরি করে চলে আসব। সামান্য কিছুক্ষণ তালাবন্ধ থাকবি মুখ চোখ শুকিয়ে কি করে ফেলেছিস।’ ‘খালা আমি হচ্ছি মুক্ত মানুষ। এটাই সমস্যা।’ ‘বিছানায় শুয়ে বই টই পড়, টিভি দেখ। আমি তোকে কফি দিতে বলে যাচ্ছি।’ আমি বিছানায় শুয়ে শুয়েই ঘটাং ঘটাং শব্দে তালা দেয়ার আওয়াজ পেলাম। এ বাড়ির সব কিছু আধুনিক হলেও তালাগূলি সম্ভবত মান্ধাতার আমলের। বড্ড শব্দ হয়। পালকের বিছানায় মাথা রেখে শুয়ে আছি। আমাকে কফি দিয়ে গেছে। চাইনীজ খাবার কি খাব বাবুর্চি জানতে এসেছিল, হাতে নোট-বুক, পেন্সিল। আমি গম্ভীর গলায় বলেছি আরশোলা দিয়ে হট এন্ড সাওয়ার করে একটা স্যুপ খাব। চাইনীজ শুনেছি আরশোলার স্যুপ খুব সখ করে খায়। আমি কখনো খেয়ে দেখিনি। বাবুর্চি হতভম্ব গলায় বলল, স্যারের কথা বুঝতে পারলাম না। কিসের স্যুপ? ককরোচ স্যুপ। সঙ্গে মাশরুম দিতে পারেন, বেবী কর্ণ ঠিক ততটুকু, বেশিও না কমও দেবেন না।’ ‘আমি স্যার আসলে আপনার কথা বঝুতে পারছি না।’ ‘বঝুতে না পারলে বিদায় হয়ে যান।’ ‘জ্বি আচ্ছা, স্যার।’ তালাবদ্ধ বাড়িতে পড়ে আছি। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি কাজ করতে শুরু করেছে। সময় থেমে গেছে। টামই ডাইলেশন। তালাবদ্ধ অবস্থায় যে এর আগে থাকিনি তা না। তবে হাজত তালাবন্ধ থাকবে এটা স্বীকৃত সত্য বলে খারাপ লাগে না। তালা খোলা অবস্থায় হাজতে বসে থাকাটা বরং অস্বস্তিকর। কিন্তু স্বর্গপুরীতে তালাবন্ধ অসহনীয়। শুয়ে শুয়ে ভাবাছি বেহেশত কেমন হবে? সেখানেও কি এ রকম তালা সিস্টেম থাকবে। না-কি বেহেশতবাসীরা মুক্ত স্বাধীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে পারবে। কারো ইচ্ছা সে দোজখে তার কোন পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এল। বেহেশতের বর্ণনা ভাল মত জেনে নিতে হবে। খালার নামাজ ঘরে প্রচুর ধর্মের বই-টই আছে। সেখানে বেহেশত সম্পর্কে কি লেখা আছে পড়তে হবে। কফি খাচ্ছি, কফিতে কোন স্বাদ পাচ্ছি না। স্বাদ যেমন নেই, গন্ধও নেই। একটু পর পর চোখ চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে। ঘড়ি মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বিখ্যাত বাবা আমাকে বন্দি থাকার ট্রেনিং অতি শৈশবে দিয়ে দিয়েছেলেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল মহাপুরুষ বানানোর জন্যে এই ট্রেনিং অতি জরুরি। বন্দি না থাকলে ‘মুক্তি’র স্বরুপ বোঝা যায় না। কাজেই একদিন আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিলেন—তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। যতটা অবাক হওয়ার কথা ততটা হলাম না। বাবার পাগলামীর সঙ্গে ততদিনে পরিচিত হয়ে পড়েছি। আমার ধারণা সন্ধ্যা নাগাদ তালা খোলা হবে। আতংকে অস্থির হয়ে লক্ষ্য করলাম সন্ধ্যার পর পর বাবা বাড়ি ছেড়েই চলে গেলেন। যাবার সময় মেইন সুইচ অফ করে দিলেন। একেবারে কবরের অন্ধকার। ঐটা ছিল আমার বাবার ভয় জয় করা ট্রেনিং-এর প্রাথমিক অংশ। তাঁর ডায়েরীতে তিনি লিখেছিলেন— “অদ্য রাজনীতে হিমালয়কে জয় করিবার প্রস্তুতিসূচক ট্রেনিং দেওয়া হইবে। মানুষের প্রধান ভয় অন্ধকারকে। যে অন্ধকারের স্মৃতি সে অন্য কোন ভূবন হইতে লইয়া আসিয়াছে। অন্ধকারকে জয় করার অর্থ সমস্ত ভয় জয় করা। অদ্যকার অন্ধকার জয় করা বিষয়ক প্রাথমিক ট্রেনিং হিমালয় কিভাবে গ্রহণ করিবে বুঝিতে পারিতেছি না। এই শক গ্রহণ করিবার মানসিক শক্তি কি তাহার আছে? বুঝিতে পারিতেছি না। কাহাকেও বাহির হইতে দেখিয়া তাহার মানসিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। সেই দিব্য দৃষ্টি প্রকৃতি মানব সম্প্রদায়কে দেয় নাই……” আমি ইন্টারকম টিপে বাবুর্চিকে ডাকলাম। ইন্টারভ্যু নেয়ার ভঙ্গিতে বললাম,কি নাম? ‘ইদ্রিস।’ শুরুতে তাকে আপনি করে বলেছিলাম, এখন তুমি। ‘শোন ইদ্রিস! এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে? বাথরুম থেকে পাইপ বেয়ে নেমে পড়া বা এ জাতীয় কিছু?’ ‘জ্বি না।’ ‘টেলিফোন নিয়ে আস। দমকল অফিসে টেলিফোন করে দি। ওরা তালা খুলে উদ্ভার করবে।’ ‘টেলিফোন নাই স্যার।’ ‘টেলিফোন নাই মানে?’ ‘এই বাড়িতে সব আছে টেলিফোন নাই। টেলিফোনে লোকজন বিরক্ত করে। ম্যাডামের ভাল লাগে না।’ ‘ও, আচ্ছা।’ ‘স্যার, আরেক কাপ কফি এনে দেই। চিন্তার কিছু নাই ম্যাডাম চলে আসবে। উনি বেশীক্ষণ বাডীর বাইরে থাকেন না। চলে আসেন। কফি দিব স্যার?’ ‘দাও।’ বাবুর্চি কফি এনে দিল। আমি কফি খেয়ে রেশমা খালার অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সেই ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন দেখি রাত হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। ‘কিরে ঘুম ভেঙ্গেছে? রেশমা খালা ঘরে ঢুকে বাতি জ্জালালেন। তিনি মাথার নকল চুল খুলে ফেলেছেন। তাঁকে মোটামুটি বীভৎস দেখাচ্ছে। তাঁর মাথার আদি চুলের এই অবস্থা কে জানত। কিছু আছে কিছু নেই। যেখানটার মাথার হলুদ চামড়া চকচক করছে। ‘ঘরে ফিরে দেখি তুই মরার মত ঘুমুচ্ছিস। তাই আর ঘুম ভাঙ্গালাম না। ঘুমের মুল্য কি তা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। এতক্ষণ ধরে কেউ ঘুমুতে পারে তাও জানতাম না। তোর কোন অসুখ বিসুখ নেই তো?’ ‘কটা বাজে খালা?’ ‘নটার কাচাকাছি। তুই এক নাগাড়ে প্রায় দশঘণ্টা ঘুমুলি। ক্ষিধে লেগেছে নিশ্চয়ই। হাত-মুখ ধুয়ে আয় ভাত খাই।’ আমি উঠলাম। শান্ত গলায় বললাম, ভাত খেয়েই আমি একটু বেরুব খেলা। ‘বের হতে চাইলে বের হবি। আমি কি তোকে আটকে রেখেছি না-কি? বাবুর্চি বলছিল তালা দিয়ে যাওয়ায় তুই নাকি অস্থির হয়ে পড়েছিলি। আশ্চার্য। তুই কি ছেলেমানুষ না-কি? তুই আবার তাকে বলেছিস তেলাপোকার স্যুপ খেতে চাস। হি হি হি। বাবুচিটা বোকা টাইপের, ও সত্যি ভেবে বসে আছে। ঠাট্টা বুঝতে পারেনি।’ ‘তেলাপোকার স্যুপ তৈরি করেছে? আমি ঠাট্টা করিনি। আসলেই খেতে চেয়েছিলাম।’ ‘তুই দেখি আচ্ছা পাগল। আয় খেতে আয়। খেতে খেতে আমার ভয়ংকর গল্পটা বলব। তুই আবার চারদিকে বলে বেড়াবি না।’ ডাইনিং রুম ছাড়াও ছোট্ট একটা খাবার জায়গা আছে। শ্বেত পাথরের টেবিলে দু’টা মাত্র চেয়ার। মোমবাতি জ্বালিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। টেবিলে নানান ধরনের পদ সাজানো। বাবুর্চি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। খালা বললেন, ‘তুমি চলে যাও, তোমাকে আর লাগবে না। খাওয়া শেষ হলে ঘণ্টা বাজাব তখন সব পরিষ্কার করবে।’ ‘ঘণ্টার ব্যবস্থাও আছে?’ ‘আছে, সব ব্যবস্থাই আছে। খাওয়া শুরু কর। বাবুর্চির রান্না কেমন বলবি। রান্না পছন্দ না হলে ব্যাটাকে বিদেয় করে দেব। ব্যাটার চোখের চাউনি ভাল না। স্যুপটা কেমন?’ ‘ভাল। খুব ভাল।’ ‘তুই তো এখনো মুখেই দিস নি। মুখে না নিয়েই বলে ফেললি ভাল?’ ‘গন্ধে গন্ধে বলে ফেলেছি। চায়নীজ খাবারের আসল স্বাদ গন্ধে। গন্ধে ঠিক আছে। বাবুর্চি রেখে দাও।’ ‘চোখেরা চাউনিটা যে খারাপ। মাঝে মাঝে ভয়ংকর করে তাকায়।’ ‘বু্দ্ধিটা খারাপ না। ভাল বলেছিস হিমু। এটা আমার মাথায় আসেনি। কথায় আছে না এক মাথার থেকে দুমাথা ভাল—আসলেই তাই। এখন আমার সমস্যাটা শোন। খু্ব মন দিয়ে শুনবি।’ ‘খাওয়া শেষ হোক তারপর শুনি…’ ‘খেতে খেতেই শোন। আমি আবার চুপচাপ খেতে পারি না। ব্যাপারটা কি হয়েছে শোন। তোর খালু মারা যাবার পর বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল ফালতু লোকে। অমুক আত্নীয় তমুক আত্নীয়। এক্কেবারে খুঁটি গেড়ে বসেছে। মতলব আর কিছু না—টাকা পয়সা হাতানো। টাটকা মধু পড়ে আছে—পিঁপড়ার দল চারদিক থেকে এসে পড়েছে। আমি একে একে ঝোঁটিয়ে সব বিদায় করলাম। বাড়ি খালি করে ফেললাম। চব্বিশঘণ্টা গেটে তালার ব্যবস্থা করলাম। একজনের জায়গায় দু’জন দারোয়ান রাখলাম। চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। কাউকে ঢুকতে দেবে না। কেউ যদি ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি নট। আমার যদি কারোর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয় আমি নিজেই দেখা করতে যাব। কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। লোকজন টেলিফোনে বিরক্ত করে। দিলাম টেলিফোন লাইন কেটে। এত বড় বাড়িতে আমি একা । একটু যে ভয় ভয় লাগে না, তা না। লাগে কিন্তু আত্মীয় স্বজনের যন্ত্রণায় চেয়ে ভয় পাওয়া ভাল। লক্ষ গুণ ভাল। তারপর একদিন কি হয়েছে শোন । রাত এগারোটার মত বাজে । খুব দেখি মশা কামড়াচ্ছে। দরজায়, জানালায় নেট আছে তারপরেও এত মশা ঢুকল কি ভাবে? আমার মেজাজ খারাপ। কারণ আমি আবার মশারির ভেতর ঘুমাতে পারি না। আমার একটা কাজের মেয়ে ছিল রেবা। ওকে বললাম মশারি খাটিয়ে দিতে। ও মশারি খাটিয়ে দিল। মেজাজ টেজাজ খারাপ করে ঘুমুতে গেছি। বাতি নিভিয়ে মশারির কাছে গেলাম, মশারি তুলে দেখি মশারীর ভিতর ও বসে আছে। তোর খালু। নেংটা হয়ে বসে আছে। গুটিসুটি মেরে বসা। মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান। সেই থেকে শুরু। কখনো তাকে দেখি খাটের নিচে।কখনো বাথরুমের বাথটবে। একদিন পেলাম ডীপ ফ্রীজে। ‘কোথায়, ডীপ ফ্রীজে?’ ‘হ্যাঁ। ডীপ ফ্রীজ সব সময় বাবুর্চি খোলে। সেদিন ফ্রীজে জিনিসপত্র কি আছে দেখার জন্যে ডালটা তুললাম—দেখি একেবারে খালি ফ্রীজ, সেখানে ও বসে ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছে। এই হল ব্যাপার, বুঝলি। এরপর থেকে রাতে ঘুমুতে পারি না।’ ‘রোজই দেখ?’ ‘প্রায়ই রোজই দেখি।’ ‘আজ দেখেছ?’ ‘এখনো দেখিনি। তবে দেখব তো বটেই। এর মানেটা কি বল তো হিমু? এই অত্যাচারের কারণ কি? ভূত প্রেত বলে সত্যি কিছু আছে? মানুষ মরলে ভূত হয়?’ আমি দেখলাম রেশমা খালা আর কিছু খেতে পারছেন না। মুখ শুকিয়ে গেছে। হাত কাঁপছে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, হিমু কথা বলছিস না কেন? ‘তুমি একাই উনাকে দেখ না আরো অনেকেই দেখে?’ ‘সবাই দেখে। রেবা দেখেছ। দেখে চাকরি-টাকরি ছেড়ে চলে গেছে। আমার সাথে যারা আছে তারাও দেখেছে। এরা কেউ রাতে দোতলায় ওঠে না। তুই রাতটা আমার সঙ্গে থাক। তুইও দেখবি।’ আমি খালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই প্রথম বেচারীর জন্যে মায়া লাগছে।
Post a Comment